Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 8:09 pm

নতুন আইনে হোক ধর্ষণ নির্মূলের অঙ্গীকার

ইরানী বিশ্বাস: স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে নিয়ে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ সংঘটিত হয় ২৫ সেপ্টেম্বর। ধর্ষণের শিকার নারীর শনাক্ত করা সব আসামিকে পুলিশ আটক করেছে। বহুল আলোচিত নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সারা দেশে ভাইরাল হয়। উল্লিখিত ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন, পর্নোগ্রাফি আইন এবং ধর্ষণ মামলায় ওই নারী তিনটি মামলা করেন। এতে ৯ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত পরিচয় সাত-আটজনকে আসামি করা হয়। এ তিন মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে পাঁচজন নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া ১০ অক্টোবর সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের তেলিখালই ইউনিয়নের চাতলপাড় গ্রামে সাত বছরের মেয়েকে সকাল ১০টার সময় হƒদয় নামে এক প্রতিবেশী ধর্ষণের চেষ্টা করে। অভিযোগ পেয়ে ওই দিন রাতে ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সিলেটের শামীমাবাদ আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডে ৯ অক্টোবর পাঁচ সন্তানের জননীকে ঘরে ঢুকে তিনজন সহযোগীকে নিয়ে দেলোয়ার নামে এক ব্যক্তি ধর্ষণ করে। রাতে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলে পুলিশ অভিযুক্ত দেলোয়ার ও এক সহযোগী হারুনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২ সেপ্টেম্বর নগরীর দাড়িয়াপাড়া এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে এক বাসায় এনে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষক মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগকর্মী রাকিব হোসেন নিজু। থানায় লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১০ অক্টোবর রাকিব হোসেন নিজুকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ।

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার বাবুখালী গ্রামের নাসির মোল্লা (২০) মোবাইল ফোনে কিশোরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৩ অক্টোবর রাতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে মধুমতী নদীর চরে নিয়ে চার বন্ধুসহ প্রেমিক নাসির তাকে ধর্ষণ করে। অভিযোগের ভিত্তিতে পরদিন প্রেমিক নাসিরের সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলেও নাসির পলাতক রয়েছে।

বেগমগঞ্জ উপজেলায় তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে থানা পুলিশ ধর্ষক আবুল খায়েরকে (৪৫) আটক করেছে। ধর্ষণের ব্যাপারে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। কোথাও ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ওপরে বর্ণিত প্রথম দুটি ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে মানুষের মধ্যে তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঠিক একই সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল হয় পুরো দেশ। ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানÑসব সময় এমন বর্বর ঘটনা ছিল। তবে সমাজ যত অগ্রসর হচ্ছে, বর্বরোচিত ধর্ষণের ঘটনা যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। পুলিশ ধর্ষণের ঘটনাকে জিরো টলারেন্স নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। যেখানেই ধর্ষণের অভিযোগ পাচ্ছে, কালক্ষেপণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। এ ব্যাপারে পুলিশের পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে।

বাংলাদেশে বছরের শুরু থেকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৪৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে ৯ জন। আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে ১৯২ জন। ধর্ষণের অভিযোগে থানায় দায়ের করা মামলার প্রায় সবগুলোতেই আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কোনো কোনো মামলার নিষ্পত্তি এরই মধ্যে হয়েছে, কোনোটি নিষ্পত্তির পথে আর কোনোটি চলমান ও প্রক্রিয়াধীন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ বলতে বোঝানো হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে।

আইনের ৯/১ ধারায় ধর্ষণের জন্য সাজা ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এটি সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্ষকরা পশু। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবনের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মন্ত্রিসভায় আইন পাস করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আইন সংশোধনের মাধ্যমে এসিড নিক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এসিড সন্ত্রাসের মতো ধর্ষণ নামের পাশবিকতা নিয়ন্ত্রণেই সরকার আইন সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করেছে। যেহেতু পার্লামেন্ট সেশন নেই, তাই আমরা এক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করে দিচ্ছি।

এখন থেকে ধর্ষণের শাস্তি হবে হয় মৃত্যুদণ্ড, নাহয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একই সঙ্গে ৯/৪ ধারায়ও সংশোধন আনা হয়েছে। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১/গ ধারায় সাধারণ জখম আপসযোগ্য করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল মন্ত্রিসভায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনের সকল সংশোধনী প্রস্তাব মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। এর ফলে বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোয় সংশোধনী আনা হবে। এছাড়া নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ধর্ষণের সব মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় ছাত্র সংগঠনসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিক্ষোভ-সমাবেশ অব্যাহত ছিল। ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের তীব্রতায় সরকারের আইন পরিবর্তনের এই পদক্ষেপ যুগান্তকারী বলেও মনে করা হচ্ছে। দেশে নতুন আইন প্রণয়নের খবরে সর্বমহলে স্বস্তি নেমে এসেছে। আইনের এই সংশোধনীর কারণে বাংলাদেশে ধর্ষণের হার কমবে বলে আশা করা যায়।

ধর্ষণ ঠেকাতে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। তবে সাধারণ জনগণ হিসেবেও আন্তরিক হওয়া জরুরি। সরকার আইন প্রণয়ন করে জনকল্যাণের কাজে। রাষ্ট্রের প্রতি বা সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে জনগণেরও উচিত প্রণীত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা। প্রতিটি মানুষ যদি নিজে সচেতন হন এবং পাশের মানুষটিকে সচেতন করেন, তাহলে রাষ্ট্র বা সরকারের কঠিন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন হবে না। ধর্ষণ ঠেকাতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হোক, এটা আশা করি। তবে বাংলাদেশে আর একটিও ধর্ষক চিহ্নিত না হোক, আর কোনো মৃত্যুদণ্ড না হোকÑসচেতন মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের প্রার্থনা।

পিআইডি নিবন্ধ