Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 10:32 am

নতুন আতঙ্কের নাম সার্সের ওমিক্রন ধরন

মো. আরাফাত রহমান : বিশ্ব সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস ২-এর (সার্স-কোভ-২) ‘ওমিক্রন’ নামীয় নতুন ধরনের মুখোমুখি হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে নতুন এ ধরন সম্পর্কে রিপোর্ট করা হয়। ২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে উদ্বেগেজনক একটি ধরন হিসেবে অভিহিত করে এবং গ্রিক বর্ণমালার পঞ্চদশ অক্ষর ‘ওমিক্রন’-এর নামে নামকরণ করে। ধরনটিতে অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর পরিমাণে মিউটেশন রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিনব এবং এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার স্পাইক প্রোটিনকে প্রভাবিত করতে পারে, যেগুলো বেশিরভাগ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সময় টার্গেট হিসেবে ব্যবহƒত হয়।

ধরনটির বৈচিত্র্য, সংক্রমণযোগ্যতা, ইমিউন সিস্টেম ফাঁকি দেয়া এবং ভ্যাকসিন প্রতিরোধের মতো বিষয়গুলো উদ্বেগের বড় কারণ। ফলস্বরূপ ধরনটিকে দ্রুতই উদ্বেগের বিষয় হিসাবে মনোনীত করা হয়েছে এবং এর আন্তর্জাতিক বিস্তারকে সীমিত বা ধীর করার জন্য বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা চালু করেছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাস বিবর্তনের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা গ্রুপ লিনিয়েজ বি.১.১.৫২৯-কে উদ্বেগের একটি রূপ হিসাবে ঘোষণা করেছে এবং এটিকে গ্রিক অক্ষর ওমিক্রন দিয়ে চিহ্নিত করেছে।

বি.১.১.৫২৯ লিনিয়েজে আক্রান্তের সংখ্যা সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার গৌতেং প্রদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ পাওয়া গেছে, এই ধরনটি আবার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। সংক্রমণযোগ্যতা, মৃত্যুহার এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর এর প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য গবেষণা চলছে। এই ধরন এবং এর ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা-সম্পর্কিত বিষয়গুলো এখনও গবেষণাধীন। ডেল্টা ধরনের তুলনায় ওমিক্রনের সংক্রমণযোগ্যতা সম্পর্কে এখনও বিশাল অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে সম্ভাব্য ১০০ ভাগ থেকে ৫০০ ভাগ বৃদ্ধিসহ সংক্রমণযোগ্যতার হিসাবে তা ছয়গুণ। ধরনটি যখন শনাক্ত করা হয়, তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কম কিন্তু ক্রমবর্ধমান ছিল এবং এটি অজানা যে ধরনটি ডেল্টার চেয়ে বেশি সংক্রমণযোগ্য কি না।

ওমিক্রনের প্রথম নমুনাটি বতসোয়ানা থেকে ৯ নভেম্বর সংগ্রহ করা হয়। এটি দক্ষিণ আফ্রিকাতেও শনাক্ত করা হয়। একটি নিশ্চিত নমুনা ইসরাইলে মালাউই থেকে ফিরে আসা এক ভ্রমণকারীর মধ্যে শনাক্ত হয়। বতসোয়ানা থেকে রিপোর্ট করা প্রাথমিক চারটি ঘটনাই সম্পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটেছে। ইসরাইল থেকে রিপোর্ট করা তিনটি প্রাথমিক নিশ্চিত এবং সন্দেহজনক কেসই সম্পূর্ণভাবে টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঘটেছে, যেমনটি জার্মানিতে একজন সন্দেহভাজনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। যুক্তরাজ্যে দুটি, জার্মানির মিউনিখে দুটি এবং ইতালির মিলানে একটি নমুনা শনাক্ত করা হয়েছে। ডাচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রিপোর্ট করেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমস্টারডাম বিমানবন্দরে অবতরণকারী দুটি ফ্লাইটের প্রায় ৬০০ যাত্রীর মধ্যে ৬১ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ জনের মধ্যে পরে ওমিক্রন ধরন রয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে দুটি নমুনা ধরা পড়ে। উভয় ব্যক্তি আগের দিন সিডনিতে অবতরণ করেছিলেন এবং তারা আফ্রিকার দক্ষিণাংশ থেকে দোহা, কাতার হয়ে সিডনিতে যাত্রা করে। সম্পূর্ণভাবে টিকাপ্রাপ্ত এই দুই ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ আইসোলেট করা হয়। আফ্রিকার দক্ষিণাংশ থেকে আসা আরও ১২ ভ্রমণকারীকেও ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয় এবং ফ্লাইটের প্রায় ২৬০ যাত্রী ও ক্রুকে আইসোলেট করার নির্দেশ দেয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা দুই যাত্রী ডেনমার্কে অবতরণ করে, যাদের কভিড-১৯ ধরা পড়ে এবং পরে নিশ্চিত হওয়া যায় ওই দুজন ভ্রমণকারী ওমিক্রন ধরন বহন করছিলেন। অস্ট্রিয়াও তাদের প্রথম ওমিক্রন কেস নিশ্চিত করেছে। আফ্রিকান দেশ নামিবিয়াতে সময় কাটিয়েছেন এমন একজন ভ্রমণকারীর শরীরে থেকে চেক প্রজাতন্ত্রে একটি শনাক্ত করা ওমিক্রন কেস রিপোর্ট করা হয়। নাইজেরিয়া থেকে আসা যাত্রীদের কাছ থেকে কানাডাও তার প্রথম ওমিক্রন কেস রিপোর্ট করেছে।

২৯ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলের ডারউইনে একটি করোনার নমুনা রেকর্ড করা হয়। লোকটি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ থেকে প্রত্যাবর্তন ফ্লাইটে ডারউইনে পৌঁছান এবং তাকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ওমিক্রন কেস রেকর্ড করা হয়। একই ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আসা যাত্রীদের মধ্যে আরও দুটি ওমিক্রন কেস পাওয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশগুলোকে ভ্রমণের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ না করার পরামর্শ দিয়েছে এবং এর পরিবর্তে ভ্রমণ ব্যবস্থায় ঝুঁকিভিত্তিক এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সুপারিশ করেছে। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল রিপোর্ট করেছে, কঠোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ইউরোপীয় দেশগুলোয় ধরনটির প্রভাবকে দুই সপ্তাহ বিলম্বিত করবে এবং দেশগুলোকে এটির জন্য প্রস্তুত হতে দেবে।

ধরনটিতে প্রচুর পরিমাণে মিউটেশন রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কিত। ৩২টি মিউটেশন স্পাইক প্রোটিনকে প্রভাবিত করে, যা সংক্রমণের দ্বারা উৎপন্ন অ্যান্টিবডিগুলোর এবং ব্যাপকভাবে পরিচালিত অনেক টিকার প্রধান অ্যান্টিজেনিক টার্গেট হিসেবে কাজ করে। এই মিউটেশনগুলোর অনেকগুলো অন্যান্য স্ট্রেইনে পরিলক্ষিত হয়নি। ধরনটিকে মূল ভাইরাসের তুলনায় ৩০টি অ্যামিনো অ্যাসিড পরিবর্তন, তিনটি ছোট ডিলিশন এবং স্পাইক প্রোটিনে একটি ছোট ইনসার্শন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে অবস্থিত। এটি অন্যান্য জিনোমিক অঞ্চলে অনেকগুলো পরিবর্তন ও ডিলিশনও বহন করে। ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে ধরনটির তিনটি মিউটেশন রয়েছে। ফিউরিন ক্লিভেজ সাইট সার্স-কোভ-২-এর সংক্রমণ বাড়ায়।

কোনো অস্বাভাবিক উপসর্গ এখনও ওমিক্রন ধরনে দেখা যায়নি এবং অন্য ধরনের মতো এক্ষেত্রেও কিছু ব্যক্তি উপসর্গবিহীন থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ার ডা. অ্যাঞ্জেলিক কোয়েটজি প্রথম রোগীদের মধ্যে এই ধরনটি শনাক্ত করতে সক্ষম হন, যাদের ক্লান্তি ও ব্যথা ছিল, কিন্তু কাশি, গন্ধ বা স্বাদের অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং উৎসাহব্যাঞ্জক যে সেখানকার ডাক্তাররা রিপোর্ট করছেন, ওমিক্রন হাসপাতালে ভর্তির কোনো বৃদ্ধি ছাড়াই হালকা উপসর্গ সৃষ্টি করছে। তবে এটি দেখার দরকার যে ধরনটি বয়স্ক মানুষদের শরীরে কী প্রভাব ফেলে, যারা কোভিডের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্যান্য ধরনের মতোই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানুষকে আবদ্ধ স্থানগুলোয় ভালোভাবে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে, ভিড় ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়াতে, ভালোভাবে ফিটিং মাস্ক পরতে, ঘনঘন হাত পরিষ্কার করতে এবং টিকা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বায়োএনটেকের মতে, বর্তমান ভ্যাকসিনটি ওমিক্রন ধরনের বিরুদ্ধে কার্যকর কি না, তা দুই সপ্তাহের মধ্যেই জানা যাবে এবং প্রয়োজনে ১০০ দিনের মধ্যে একটি আপডেট করা ভ্যাকসিন পাঠানো যেতে পারে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না এবং জনসনও ওমিক্রন ধরনের ওপর তাদের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার প্রভাব গবেষণা করছে।

বর্তমান পিসিআর পরীক্ষাগুলো ওমিক্রন ধরন শনাক্ত করতে পারে। কিছু পরীক্ষাগার ইঙ্গিত দিয়েছে, একটি বহুল ব্যবহƒত পিসিআর পরীক্ষা তিনটি টার্গেট জিনের মধ্যে একটি শনাক্ত করে না। ঠিক যেমন আলফা ধরনের সঙ্গে, এই আংশিক শনাক্তকরণটি ধরনের জন্য একটি মার্কার হিসেবে কাজ করতে পারে। দ্রুত অ্যান্টিজেন পরীক্ষাও প্রভাবিত হয় না। স্পাইক প্রোটিনের অনেক মিউটেশন অন্য ধরনগুলোয় উপস্থিত রয়েছে এবং এটি বর্ধিত সংক্রামকতা এবং অ্যান্টিবডির সঙ্গে সম্পর্কিত। কম্পিউটেশনাল মডেলিং পরামর্শ দেয়, ওমিক্রন ধরনটি কোষমধ্যস্থ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে বাঁচতে পারে।

নিরাময়কারী ভ্যাকসিনের সক্ষমতার সম্ভাব্য প্রতিরোধ ক্ষমতা মূল্যায়ন করার জন্য একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন জরুরিভাবে একান্ত প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত এটি অজানা যে কীভাবে ওমিক্রন ধরনটি উচ্চ স্তরের অনাক্রম্যতা-সহ জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়বে এবং এটিও অজানা যে ধরনটি হালকা বা আরও গুরুতর কোভিড সংক্রমণ ঘটায় কি না। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মতে, প্রয়োজন হলে প্রায় ১০০ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিনগুলো পরিবর্তন করা যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশগুলোকে কিছু নির্দেশিকা অনুসরণ করতে বলেছে, যেমন ১. বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ-২ ধরনগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য নজরদারি এবং সিকোয়েন্সিং প্রচেষ্টা বাড়ানো; ২. একটি সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ ডেটাবেসে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স এবং এ-সম্পর্কিত মেটডেটা জমা দেয়া; ৩. এর সঙ্গে সম্পর্কিত ভাইরাস-অফ-কনসার্ন সংক্রমণের বিষয়ে আইএইচআার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় প্রাথমিক কেস/ক্লাস্টার রিপোর্ট করা এবং ৪. যেখানে সক্ষমতা বিদ্যমান, সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কোভিড-১৯ মহামারির উদ্বেগজনক ভাইরাসের সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বোঝার জন্য মাঠপর্যায়ে গবেষণা এবং পরীক্ষাগার মূল্যায়ন করা, জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা, ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি, ইমিউনিটি প্রতিক্রিয়া এবং অ্যান্টিবডি নিরপেক্ষকরণ বা অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করা।

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়