চামেলী বৈরাগী: ডায়রিয়া (উরধৎৎযবধ), আগে যেটি পরিচিত ছিল কলেরা নামে। কলেরা ভিবরিও কলেরা (ঠরনৎরড় পযড়ষবৎধব) নামক ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ক্ষুদ্রান্তের একটি সংক্রামক রোগ। বিশ্বে প্রথম কলেরা মহামারি দেখা দেয় ১৮১৭ সালে।
ইংল্যান্ডে যা মহামারি রূপ নেয় ১৮৩০-এর দশকে এবং ১৮৩০ থেকে ১৮৫০-এর দশক পর্যন্ত ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। উনিশ শতকে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। তখন এই রোগের রহস্য ভেদ করা বিজ্ঞানীদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসকরা তখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, এই রোগ কীভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে। ভিক্টোরিয়ান যুগের মানুষ তখন মনে করত দুর্গন্ধময় বাতাসের মাধ্যমে কলেরা ছড়ায়। সেই সময় জন স্নো নামে একজন ব্রিটিশ ডাক্তার প্রথম ধরতে পারেন, কলেরার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত পানির মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়।
বাংলাদেশে প্রথম এ রোগ দেখা দেয় যশোরে। কমবেশি সারা বছর মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলেও ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। ঋতু পরিবর্তনের কারণে, প্রচণ্ড গরমে দ্রুতগতিতে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। ডায়রিয়া আক্রান্তদের বেশির ভাগ শিশু এবং বৃদ্ধ। রাজধানীতে ডায়রিয়া পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশর (আইসিডিডিআর,বি) তথ্যমতে, গত ৬২ বছরের ইতিহাসে ডায়রিয়া রোগীর এত চাপ দেখেনি কেউ। প্রতিদিন ১ হাজারেরও বেশি রোগী আসছে হাসপাতালটিতে। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। চাপ সামলাতে হাসপাতালের বাইরে ৬-৭টি শামিয়ানা টানিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কিছু রোগীকে পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে। অনেক রোগীকে ভর্তি না করে ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ‘বেড নেই’ বলে বিদায় জানাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আইসিডিডিআর,বির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মার্চ ১ হাজার ৫৭ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। পরদিন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৪১ জনে ২০ মার্চ রোগীর সংখ্যা হয় ১ হাজার ১৫৭, ২১ মার্চ ১ হাজার ২১৬, ২২ মার্চ ১ হাজার ২৭২ ও ২৩ মার্চ ১ হাজার ২৩৩ জন। এছাড়া ২৪ মার্চ ১ হাজার ৭৬, ২৫ মার্চ ১ হাজার ১৩৮, ২৬ মার্চ ১ হাজার ২৪৫, ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৩০ এবং ২৮ মার্চ ১ হাজার ৬৫৫ জন ভর্তি হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে শিগগিরই এটি মহামারির রূপ নেবে। ডায়রিয়া বা উদরাময় হল প্রতিদিন কমপক্ষে তিনবার পাতলা বা তরল মলত্যাগ করার ফলে যে রোগ হয় তাকে বোঝায়। এটি মূলত পৌষ্টিক তন্ত্রের একটি রোগ যাতে মলের সঙ্গে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যায়। ডায়রিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে। সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী, অথবা গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিসনামে পরিচিত রোগের কারণে অন্ত্রের একটি সংক্রমণ। এই সংক্রমণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মল দ্বারা দূষিত খাবার বা পানীয় থেকে হয় অথবা সংক্রমিত অন্য কোনো ব্যক্তির থেকে সরাসরি সংক্রমিত হতে পারে। কলেরা জীবাণু দ্বারা ডায়রিয়া হলে প্রতিদিন শরীর থেকে ২০-৩০ লিটার পানি বের হয়ে যায়। যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সাধারণত জীবাণু দ্বারা ডায়রিয়া সংক্রমণ বেশি হলে ও দূষিত পানি পান, দূষিত ও পচা বাশি খাবার গ্রহণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবেও ডায়রিয়া হয়ে থাকে। ডায়রিয়ার লক্ষণগুলো হলো ২৪ ঘণ্টায় তিনবার বা এর বেশি পানিসহ পাতলা পায়খানা হওয়া, শরীর দুর্বল হওয়া, খাওয়ায় রুচি কমে যাওয়া, ডায়রিয়া শুরুর প্রথম দিকে বমি হওয়া ও গায়ে হালকা জ্বর থাকা।
ডায়রিয়ার চিকিৎসা হিসাবে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন শরীরে পানিশূন্যতা রোধ করে।
স্যালাইনের পাশাপাশি ভাতের মাড় বা অন্য কোনো বিশুদ্ধ পানীয় পান করাতে হবে, যাতে শরীরে লবণ-পানির ঘাটতি পূরণ হয়। তবে ঘাটতি বেশি হলে সে ক্ষেত্রে কলেরা স্যালাইন দিতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে বারবার খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। ছয় মাসের কম বয়সী শিশুকে শুধু মায়ের দুধ ও স্যালাইন খাওয়াতে হবে। বেশি করে তরল খাবার যেমন: ভাতের মাড়, চিড়ার পানি, ডাবের পানি খাওয়াতে হবে।
খাবার তৈরির আগে, শিশুকে খাওয়ানোর আগে এবং পায়খানার পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে। শিশুকে স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে, যেসব শিশু মায়ের দুধ খায় তাদের ঘনঘন মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জিঙ্ক খাওয়াতে হবে এবং বোতলের দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, মলত্যাগ করার পর সাবান দিয়ে হাত ধুলে ডায়রিয়ার আশঙ্কা ৪০ শতাংশ হ্রাস করে। তাই বড়দের পাশাপাশি শিশুদেরও খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নখ কেটে সব সময় ছোট রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের। খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে, পরিষ্কার স্থানে খাবার রাখতে হবে। শৌচাগার থেকে ফেরার পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। হাতের কাছে সাবান না থাকলে ছাই দিয়ে হাত ধুতে হবে। প্রতিটি বাসাবাড়িতে খাওয়ার স্যালাইন ও জিংক ট্যাবলেট সব সময় মজুত রাখতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে জিংক ট্যাবলেট খেতে হবে।
ডায়রিয়া কোনো মরণব্যাধি নয়। প্রয়োজনীয় সচেতনতা অবলম্বন করলেই ডায়রিয়া থেকে পরিত্রাণ লাভ করা সম্ভব। একটা সময় ছিল যখন ডায়রিয়ায় অনেক প্রাণহানি হতো। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বর্তমানে ডায়রিয়ায় প্রাণহানি রোধ করা অনেকটাই সম্ভব হয়েছে। ডায়রিয়ার চিকিৎসক ও গবেষকদের মতে ডায়রিয়া উপশমের পদ্ধতি আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু তাতে রোগ নিরাময় হলেও প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ডায়রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। এছাড়া বাইরের দূষিত খাবার ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এড়িয়ে চললে ডায়রিয়ার প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মাহে রমজান
রোজা (ফার্সি রুজে), সাউম (আরবি সউম) বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির একটি। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার এবং সে সঙ্গে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। ইসলামি বিধান অনুসারে, প্রতিটি সবল মুসলমানের জন্য রমজান মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা ফরজ; যার অর্থ অবশ্যই পালনীয়।
রোজা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘পানাহার বা বিরত থাকা’। আর আরবিতে এর নাম সাওম বা সিয়াম। রোজা ফার্সি শব্দ। আরবি শব্দ হলো আস-সাওম। বাংলায় রোজার অর্থ বিরত থাকা, সংযম করা, কঠোর সাধনা করা প্রভৃতি। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার, সে সঙ্গে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা।
পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে: হে ঈমানদাররা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)
সিয়াম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূর্ণ করবে। এটা যাদের অতিশয় কষ্ট দেয়, তাদের কর্তব্যÑএর পরিবর্তে ফিদইয়া (একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্যদান) করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে, তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করা তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর। (সুরা বাকারা-২:১৮৪)
আরও বলা হয়েছে, রমজান মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতস্বরূপ এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী রূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে, তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদের যে হেদায়েত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (সুরা বাকারা: ১৮৫)
আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন (গুনাহ হতে বাঁচার জন্য) রোজা ঢালস্বরূপ। সুতরাং রোজাদার অশ্লীল কথা বলবে না বা জাহেলি আচরণ করবে না। কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে উদ্যত হলে অথবা গালমন্দ করলে সে তাকে দুবার বলবেÑআমি রোজাদার। তিনি আরও বলেন, যার হাতে আমার জীবন, সেই সত্তার শপথ! রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মহান আল্লাহর কাছে কস্তুরীর সুগন্ধ হতেও অতি উৎকৃষ্ট। আল্লাহ বলেন, রোজাদার খাদ্য, পানীয় ও কামভাব পরিত্যাগ করে আমার উদ্দেশেই রোজা রাখে। সুতরাং আমি তাকে বিশেষভাবে রোজার পুরস্কার দান করব। আর নেক কাজের পুরস্কার ১০ গুণ পর্যন্ত দেব। (সহি বোখারি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৩)
যে ঈমান ও বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের আশায় রমজানের
রোজা রাখে
হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) ইশরাদ করেন, যে ঈমান ও বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের আশায় শবেকদরের নামাজ পড়ে এবং রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে। (বোখারি, ১/৩৩৪)
সাহ্রি খাওয়ায় বরকত লাভ হয়
হাদিস: হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেন, তোমরা সাহ্রি খাও। কেননা, সাহ্রি খাওয়ায় বরকত লাভ হয়। (বোখারি, ১/৩৩৫)
রোজাদার ভুলবশত পানাহার করলে তার হুকুম
হাদিস: আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেন, রোজাদার যদি ভুল করে কিছু খায় বা পান করে, তাহলে সে (ইফতার না করে) রোজা পূর্ণ করবে। কেননা, আল্লাহতায়ালা তাকে
পানাহার করিয়েছেন। (বোখারি, ১/৩৩৫)
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে অনতিবিলম্বে ইফতার করা
হাদিস: সাহল ইবনে সা’দ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যতদিন তোমরা তাড়াতাড়ি (সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে) ইফতার করবে, ততদিন কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না। (সহিহ্ বোখারি, ১/৩৩৬)
‘তাকওয়া’ শব্দের মূল অর্থ ‘রক্ষা করা।’ এর অনুবাদ করা হয়েছে নানাভাবে। যেমন, পরহেজগারি, আল্লাহর ভয়, দ্বীনদারি, সৎ কর্মশীলতা, সতর্কতা প্রভৃতি। রোজা ঢালের মতো কাজ করে, যা গোনাহের হাত থেকে বাঁচায়।
মুহাম্মদ আকিল নবী