মো. শফিকুল আলম ও ইব্রাহিম পাঠান: ছাত্র-জনতার একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের পর আক্ষরিক অর্থেই চারপাশে এখনো ধ্বংসাবশেষ, স্বজন হারাদের কান্না। তাহলে কি আবার ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বসংযজ্ঞ থেকে সম্ভাবনাগুলো ওঠে দাঁড়াবে না? দায়িত্ব নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সব ধরনের অরাজকতার বিষবাষ্প ব্যর্থ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো যে আবারও বলিষ্ঠ পর্যায়ে পৌঁছাবে, তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে গত ৬ আগস্ট পুঁজিবাজারে লেনদেনের শুরু থেকেই। বৃহস্পতিবার প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স রেকর্ড ৩০৬ পয়েন্ট বা প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৩ সালে সূচকটি চালু হওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ উত্থান। এ থেকে স্পষ্ট যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে নতুন বাংলাদেশ তথা পুনর্গঠিত অর্থনীতির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে তাতে আস্থা রাখছেন বিনিয়োগকারীরা। সবারই প্রত্যাশা দীর্ঘ ১৬ বছরের দুর্নীতির রাহু গ্রাস আর অপশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সঠিক নেতৃত্ব দেবে সদ্য দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকার। আমরা এখন আশা করতেই পারি অর্থনীতির সূচকগুলোকে প্রত্যাশিত স্তরে নিয়ে আসতে এই সরকার সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে, যেখানে ফ্যাসিবাদ এবং বৈষম্য বিলোপ করে মতো বিচারই প্রতিষ্ঠা করাই হবে বিবেচনার প্রধান মাপকাঠি।
মূল্যস্ফীতি: বাংলাদেশের মানুষ গড় আয়ের অর্ধেকের মতো খরচ করেন শুধু খাবার কিনতে। গরিব মানুষের খাবারের পেছনে খরচ আরও বেশি, তা-ও ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারি হিসেবেই গেল দুই বছর ধরে জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ক্ষেত্রবিশেষে এই হার আরও বেশি। বহুবার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেখ হাসিনার সরকার নিত্যপণ্যের দামের লাগাম টানতে
পারেনি। পরিত্রাণ পেতে বারবার রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেয়া হয়েছে।
একই ধরনের পরিস্থিতি অন্যদেশগুলো সহজেই উতরে যেতে পারলেও বাংলাদেশ পারেনি সিন্ডিকেট, পথে পথে দলীয় সন্ত্রাসী, পুলিশের চাঁদাবাজি আর ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে লাগাতার ব্যর্থতায়। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম কমবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। গণ-অভ্যুত্থানের পরদিন ৬ আগস্ট সকালে মুদি দোকানে গিয়ে শুনলাম, দোকানিকে তার এক শুভাকাক্সক্ষী বলছেন, ‘এখন তো তোমার সকাল-বিকাল চাঁদা দিতে হবে না। আরামে ব্যবসা করতে পারবা’। আমরাও বিশ্বাস করি চাঁদাবাজি না থাকলে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে তদারকির কোনো ঘাটতি হবে না।
ঋণখেলাপি: বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কত, এই তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক জানলেও কখনও জনগণকে সঠিক তথ্য জানানো হয়নি। সরকারের ইচ্ছায়, বিভিন্ন সময় নীতিমালার ফাঁকফোকরে খেলাপি ঋণকে কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপিকে ঋণমুক্ত করতে নীতিমালা জারি করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের জুড়ি মেলা ভার। তারপরও একটা ধারণা পেতে আমাদের বাংলাদেশ ব্যংকের ওপরেই ভরসা করতে হয়। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৭০ শতাংশ। অভিযোগ আছে, খেলাপি ঋণের একটা বড় অংশই বিনিয়োগে কাজে না লাগিয়ে পাচার করা হয়েছে। পাচার করা এসব টাকাতেই রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছেন বেগমপাড়া বা সেকেন্ড হোম। টাকা পাচার বন্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাজরদারির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফিনাসিন্সয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তবে সরষের মধ্যে ভূত তাড়াবার ব্যবস্থা করতেই হবে। আশা করছি, নতুন সরকার এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রকৃত অর্থেই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে। ব্যাংকের টাকা লুণ্ঠনকারীদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য সঠিক নীতি ও নির্দেশনা প্রণয়ন করবে। এজন্য আমলা নির্ভরতা বাদ দিয়ে বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে তিমির থেকে টেনে তুলতে পারবেন এমন একজনকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হবে। সেই সঙ্গে পরিবারতন্ত্র থেকে ব্যাংক খাতকে বাঁচাতে ব্যাংক আইনের সংশোধনসহ একটি কার্যকর সংস্কার উদ্যোগও নিতে হবে।
রিজার্ভ: এমনিতেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের খুবই নাজুক অবস্থা। এখনও আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে দেশে দেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। এরও একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের আর্থিক স্বাস্থ্যে রক্ষায়। জুলাই মাসের শেষে সপ্তাহে পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রিজার্ভের মজুত এক মাসে ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার কমে গেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের যে হিসাব করে, তাতে গত জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। জুলাই শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯ কোটি ডলারে। জনগণের লুট করা টাকা বিদেশে পাচারের কারণেও ক্রমাগতভাবে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে। এখন নিশ্চয়ই প্রবাসীরা তাদের জমানো রেমিট্যান্স পুনরায় দেশে পাঠানো শুরু করবেন এবং রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে। সঙ্গে পাচার করা টাকা ফেরানোরও কার্যকর উদ্যোগ নেবে নতুন সরকার।
কর-জিডিপি অনুপাত: বাংলাদেশের কর জিডিপির অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন, ১০ শতাংশেরও নিচে। বহুদিন ধরে বহু আলাপ হলেও এই হার বাড়ানোর জন্য কার্যকর কোনো উপায় দেখা যায়নি। উল্টো সম্পদশালীদের নানাবিধ বিতর্কিত কর সুবিধা দেয়া হয়েছে। চলতি বাজেটেই কালো টাকা সাদা করার জন্য সংসদের আইন পাস হয়েছে।
প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) আহরণের চেয়ে পরোক্ষ কর (ভ্যাট ও কাস্টম) আহরণ ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলে দরিদ্র মানুষকেও কর দিতে হয় এই দেশে। ফলে বৈষম্য বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার উপযুক্ত করহার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে অতি ধনীদের আয়ের একটা বড় অংশ আয়করের মাধ্যমে আহরণে করে তুলনামূলক সম্পদহীনদের মাঝে বিতরণ করা হবে। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে ধনীদের আয়কর হার ৪০ শতাংশের ওপরে, যেখানে বাংলাদেশে আয়কর হার সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের যে প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে, সেখানে এই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার বলে মনে করি। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সরিয়ে চৌকস ও প্রকৃত মেধাবী লোকদের দায়িত্ব দিতে হবে।
প্রয়োজনে সংস্কার করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের খোল নলচে বদলে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে
মতিউর রহমানের মতো রাঘব বোয়াল এনবিআরের দুর্বল ব্যবস্থার মধ্যেই খেয়ে মোটা-তাজা হয়েছে।
বেকারত্ব: বেকারত্বের বিষয় সবশেষ আনলেও এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ যে সময়ে সর্বোচ্চ জনসংখ্যা তাত্ত্বিক সুবিধা ভোগ করার কথা, ঠিক সময়েই শিক্ষিত বেকার সর্বোচ্চ সংখ্যায় রয়েছে। বেকারত্বের চাপে পিষ্ট হওয়া ছাত্র সমাজই জুলাই মাসের শুরুতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে গেছে। গেল পাঁচ-ছয় বছরে স্নাতক পাস বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারি হিসাবেই এই সংখ্যা ২২ লাখের কম নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ, ২০২৪) বাংলাদেশের বেকারত্ব হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়েছে। দেশে বেকার সংখ্যা এখন ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার।
এই হিসাবে বেকার সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার। সুতরাং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন সরকার দেশের বেকারত্ব নিরসনে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেবে বলে বিশ্বাস করি। খেয়াল রাখতে হবে, দেশের পেশাজীবীদের ডিঙিয়ে ভারত বা অন্যদেশের লোকেররা যেন বেশি গুরুত্ব না পায়। আমাদের এক কোটি প্রবাসী শ্রমিক যে বৈদেশক মুদ্রা দেশে পাঠান, প্রায় এর সমপরিমাণ ডলার ভারতীয়রাই এ দেশ থেকে নিয়ে যান। ফলে যে কোনো উপায়ে দেশীয় দক্ষতার মূল্যায়ন করতে হবে।
জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে দেশের শিল্প কারখানায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিযে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে টানা কয়েকদিন ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট থাকার কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যে ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে তা প–নরুদ্ধার করা কঠিন হলেও চেষ্টা করতে হবে। রপ্তানিমুখী প্রতিটি খাতকে এগিয়ে রাখতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। বিনিয়োগ সংকট দূর করতে পজিটিভ বাংলাদেশের প্রচার বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি অফিসে লাল ফিতা আর ঘুষের দৌরাত্ম্য রয়েছে। ব্যবসায়ী ও নাগরিক সেবার প্রতিটি কার্যালয়ে ঘুষ ছাড়াই সঠিক সময়ে ফাইল ছাড় করার উদ্যোগ নিতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব নেয়া নতুন সরকার অবশ্যই দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে এবং জবাবদিহির গণতন্ত্রের স্বার্থে পরমার্শগুলো বিবেচনায় নেবে বলেই প্রত্যাশা।