শেয়ার বিজ ডেস্ক: সোনালি আঁশ বিদেশে রপ্তানি করে উন্নত ও সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার সম্ভাবনাকে গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন পাটজাত পণ্য আবিষ্কার এবং বিদেশে নতুন বাজার খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পাট দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ছয়টি পাটকল ও ‘বহুমুখী পাটপণ্য মেলা-২০২৪’ এর উদ্বোধনকালে ভাষণে এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেন তার সরকার কৃষি ও রপ্তানিপণ্য হিসাবে পাটের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দেবেন। খবর: বাসস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব পণ্যের (দেশে এবং বিদেশে) বিশাল বাজার থাকায় রপ্তানি বাড়াতে নতুন পাটজাত পণ্য আবিষ্কার এবং বিদেশে নতুন বাজার খুঁজে বের করুন।’
শেখ হাসিনা বলেন, অনেক বাজার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পাটের বহুমুখী উৎপাদন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাট কৃষিপণ্য, আবার শিল্পের কাঁচামাল। রপ্তানিও হয়। এটি কৃষিরও প্রণোদনা পায় না, আবার রপ্তানিরও প্রণোদনা পায় না। আমি পরিবেশবান্ধব এ পণ্যটিকে কৃষিজাত ও রপ্তানিমুখী পণ্যের স্বীকৃতি এবং প্রণোদনা দেব।
প্রধানমন্ত্রী উদ্যোক্তা ও দেশ উভয়ের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পাট খাতের যথাযথ যতœ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমি পাটের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বলছি, আমি একটি সম্পদ আপনাদের কাছে হস্তান্তর করেছি, এর যতœ নিন। এর সঠিক ব্যবহারে আপনি এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।’
তিনি যারা পাটকলের ইজারা পেয়েছেন, তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আনবেন এবং মিলগুলো যৌথভাবে পরিচালনা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা পাটকলগুলোকে সঠিকভাবে পরিচালনায় নজর রাখবেন।
তিনি বলেন, সোনালি আঁশ, সোনার বাংলা গড়ে তোলায় বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমাদের সমৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। জাতির পিতার ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় সহায়ক হবে। এজন্য পাটের বহুমুখী ব্যবহারে নানা উদ্যোগ নেবো।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক পাটকল অলাভজনক ছিল। সেগুলো বন্ধ করে দিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিয়েছি। সম্পূর্ণ নগদ টাকা হাতে দিইনি। পারিবারিক সঞ্চয় করে দিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা করে পাটের জš§ রহস্য উদ্ভাবন করেছেন। আমি তাদের সুযোগ করে দিয়েছি। তাতে পাটের গুরুত্ব বেড়েছে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার হয়। পাটের ফার্নিচার ও আসবাবপত্র বানানো যায়। গাছের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়েছে। এটি পরিবেশবান্ধব পণ্য হওয়ায় আমাদেরও সুযোগ বেড়েছে। এ পাট শিল্পকে কীভাবে আরও প্রসার করা যায় তার সুযোগ করে দিয়েছি। পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে পারলে রপ্তানির পথ সুগম হবে। রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।
সরকার প্রধান বলেন, ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশ আর এগোতে পারেনি। আমাদের সম্পদ সীমিত। এটাকে কাজে লাগাতে জাতির পিতা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই পাটকে কাজে লাগাতে বঙ্গবন্ধুই প্রথম উদ্যোগ নিয়েছেন। পাট আমাদের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে। একে বলা হয় সোনালি আঁশ। পাট যেমন কৃষিপণ্য অন্যদিকে এটি ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল। কিন্তু এটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। পাটের কোনো কিছুই ফেলা যায় না। পাটের সব কিছুই কাজে লাগে। কৃষক যে ক্ষেতে পাট চাষ করে, সেটায় আবার ধান চাষ করে। কারণ পাট পাতা পচে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০টি মিলের মধ্যে ছয়টি চালু করায় ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বাকি ১৪টি মিল চালু হলে আরও ২৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
নতুন খোলা ছয়টি পাটকল, যেগুলো বিজেএমসি দ্বারা ইজারা দেয়া হয়েছিল কিন্তু এখন ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে সেগুলো হচ্ছেÑচট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কেএফডি জুট মিলস, নরসিংদীর ঘোড়াশালে বাংলাদেশ জুট মিলস, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে জাতীয় জুট মিলস, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ এবং যশোরের রাজঘাটে কার্পেটিং জুট মিলস এবং খুলনার খালিশপুরে দৌলতপুর জুট মিলস লি.।
প্রধানমন্ত্রী পাট খাতের উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ১১ ক্যাটাগরিতে ১১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং ৯টি পাট সংশ্লিষ্ট সমিতির হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন।
তিনি পরে পাটপণ্য মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি গোলাম দস্তগীর গাজী এবং বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুর রউফ স্বাগত বক্তৃতা করেন। জাতীয় পাট দিবস ২০২৪ উপলক্ষে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।
রপ্তানিযোগ্য পাট পণ্যের উৎপাদনে সবাইকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নতুন পন্য আবিষ্কার ও নতুন বাজার তৈরির দায়িত্ব আপনাদের। পাট পণ্যকে বহুমুখীকরণ এবং এ থেকে আর কী কী তৈরি করা যায় সে বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার।
তিনি বলেন, ২০০২ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। জেডিপিসি’র মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫০ জন বেসরকারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এই উদ্যোক্তারা প্রায় ২৮২ ধরনের পাটের তৈরি পণ্য বাজারজাত এবং রপ্তানি করছে। বর্তমানে কাঁচাপাট রপ্তানিতে প্রতিটনে সম্ভাব্য আয় হয় ৭০০-৮০০ ইউএস ডলার, ট্রেডিশনাল পাটের সুতা রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য আয় ১০০০-১২৫০ ইউএস ডলার, পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য ২০০০-৩০০০ ইউএস ডলার আর ভেলু অ্যাডেড বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানি করে প্রতি টনে সম্ভাব্য ৮০০০-১২০০০ ইউএস ডলার আয় করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পাটের সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট পণ্যের পাশাপাশি পাট দিয়ে পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, শাড়ি তৈরি হয়। গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশ্রণ করা যায়। পাটখড়ি থেকে উন্নতমানের কার্বন তৈরি হচ্ছে। পাটের আঁশ থেকে প্রসাধনী, ওষুধ, রং তৈরি সম্ভব। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাটখড়ি ব্যবহƒত হয়।
সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা দিয়ে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করা হচ্ছে। তিনি সোনালি ব্যাগের ব্যবহার দ্রুত প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণেরও আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, শিল্প খাত বিবেচনায় পাটশিল্প এখনও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। প্রতি বছর কাঁচাপাট, প্রচলিত পাটপণ্য এবং বহুমুখী পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। এদেশের পাট বিশ্বের অন্যতম নামকরা শিল্প কারখানা বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ, টয়োটা, রেনল্ট, ভলভো, অডি, ডেইমলার এ ব্যবহƒত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯১২ মিলিয়ন ইউএস ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পাটের সম্ভাবনাকে যদি আমরা সম্পূূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারি, তবে আমাদের রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে যাবে।’