খায়রুজ্জামান খান সানি: এ মাসে আমরা উদযাপন করেছি বিজয়ের বায়ান্ন বছর। এ দীর্ঘ সময়ে অনেকটা এগিয়েছে দেশ। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আজ কোন অবস্থানে এসে পৌঁছেছেতা তুলনামূলক বিচার করলেই বোঝা যায়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-র পর এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে।
ত্রিশ লাখ শহিদের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটি বিজয়ের বায়ান্ন বছর অতিক্রম করেছে। স্বাধীনতা অর্জনে শহিদ বুদ্ধিজীবী, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারির কথা বিশ্বের প্রতিটি দেশ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। মনে রাখতে হবে, আমরা এক গর্বিত জাতি যাদের পূর্বসূরি ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগে পেয়েছি মাতৃভাষা বাংলা। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্যায়, অত্যাচারের নানা ধাপ পেরিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭১ সালে। সে বছর ২৫০ মার্চ রাতে ঘুমন্ত, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়। ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। ব্যাপক লুটপাট হয়। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা লাভ করি স্বাধীনতা। বিজয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে দেশটিকে ভঙ্গুর ও পঙ্গু করে দিতে এবং বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের পাতায় এটি একটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে। বুদ্ধিজীবীরা দেশের সেরা মস্তিষ্ক। তারা জাতির বিবেক। তারা মানুষের এবং দেশের আদর্শবাদ ও সত্যের হাতিয়ার বাঁচিয়ে রাখেন। নবগঠিত দেশটির পরবর্তীতে উন্নতি লাভে তাদের দিকনির্দেশনা, পরিকল্পনা সবচেয়ে জরুরি ছিল। ১৯৭৫ সালে বাঙালি হারিয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তিনি সারাজীবন বাংলার মানুষের কথা ভেবেছেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের ৪৬৮২ দিন কারাগারে বন্দি থেকেছেন। ভঙ্গুর দেশটিকে আবার গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। তাকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হয়েছে, যা এ দেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক। এত বাধার মধ্যেও সময়ের সঙ্গে দেশ এগিয়ে চলেছে। একে একে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ করেছে। দেশের মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সফল হওয়ার তাড়নাকে কাজে লাগিয়ে নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
আমরা সুবর্ণজয়ন্তীতে পেয়েছি স্বপ্নের পদ্মা সেতু, যা সবার কাছে এক সময় অকল্পনীয় ছিল। পদ্মা সেতুর মতো আরও বেশ কিছু মেগা প্রজেক্টের কারণে দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকেও মুক্তি মিলছে অনেকের। দেশের উন্নয়নের ফলে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কিন্তু, চারপাশে তাকালে আমরা উন্নয়ন প্রচেষ্টা দেখি এরই মধ্যে আছে দুর্নীতি, চুরি, কারচুপি। এসব যেন অগ্রগামী দেশটাকে অনেক ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে। নতুন নতুন উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি ব্যাপক প্রভাব। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষেরা। যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিকই হচ্ছে কিন্তু তার সুফল বেশি দিন পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তা, সেতু ও ভবন তৈরিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি খরচ করেও তা টেকসই ও উন্নত হচ্ছে না। ব্যপাক হারে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ফলে অর্থের অপচয় ও জনদুর্ভোগ লেগেই থাকছে।
পুরো পৃথিবীর মতো বাংলাদেশকেও ২০২০ সালে মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হয়েছে। পোহাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। চাকরিচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বেকারত্ব যেখানে আগে থেকেই বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে আবার নতুন বিপদ হিসেবে হাজির হয়। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে দেশের মানুষের দুর্ভোগ যেন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে পরিবহন খরচ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সবই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার প্রায় বাইরে চলে গেছে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। একমাত্র শিক্ষাই একটি জাতিকে সার্বিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে পারে। দেশটিতে শতভাগ শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে সবার জন্য। স্কুলে প্রতি বছর বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করছে সরকার। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত! অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক আর দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব। অনেক সময় বিশবিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, ভর্তি বাণিজ্যসহ নানান প্রকার দুর্নীতির কথাপত্র পত্রিকায় উঠে আসে। ফলে সমগ্র জাতি কী শিক্ষা পাচ্ছে বা কেমন মেধাবী ছাত্র পাচ্ছে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষাসামগ্রী ক্রয় করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তদের। যাদের ঘরে চাল কেনার সামর্থ্য নেই, নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের শিক্ষালাভ স্বপ্নই রয়ে যাবে কি নাÑ সে প্রশ্ন উঠছে বারবার।
অন্যদিকে, একটি জাতির অগ্রযাত্রায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে দেশটির যুব সমাজ। কিন্তু যুবক সমাজের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এছাড়া মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ হলোÑবেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা। আইনের কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় মাদক এখন সহজলভ্য। দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই মাদক ব্যবসায়ী র্যাকেটকে প্রতিহত করতে হবে। এর জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দেশের যুব সমাজ আজ শিক্ষা লাভের পরই দেশ ত্যাগ করছে উচ্চশিক্ষা লাভ বা কর্মসংস্থানের জন্য। এ শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগানোর সুযোগ ও পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিক্ষা অর্জনের পর তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা দরকার।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে থাকে। এদেশের কৃষক ও কৃষিনির্ভর শ্রমজীবীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। দিন শেষে তারা তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এক সময় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষি খাত। কিন্তু, বার বার তাদের লোকসানে পড়তে হয়। কৃষকদের দুর্ভোগে যেন অসহনীয় মাত্রা যোগ করে বন্যা, খরার মতন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিপাকে পড়েন কৃষক সমাজ। সংকট মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে কৃষি খাত। খাদ্য জোগান দিয়ে থাকেন কৃষকেরা। তাদের ন্যায্য মূল্যে প্রদান করতে হবে। কৃষি খাতে লোন ব্যবস্থায় হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় ঘটলে বা কৃষকরা কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেলে জাতীয় অর্থনীতিই বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে দেশের একটি বড় সম্ভাবনাময় খাত হলো পর্যটন শিল্প। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার করে এসেও এ খাতে আমরা বলার মতো সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। বরং প্রাকৃতিকভাবে আশীর্বাদপুষ্ট পর্যটন স্থানগুলোকে একের পর এক ধ্বংস করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত হোটেল, রিসোর্ট তৈরি করে প্রাকৃতিক ভৌগোলিক কাঠামোকে যাচ্ছেতাইভাবে নষ্ট করছি। ফলে পাহাড়ধস, ভূমিক্ষয়, বন্যা ও বন ধ্বংস হচ্ছে। উপরন্তু রাজনৈতিক কোন্দল ও অস্থিতিশীলতার কারণে হরতাল-অবরোধ লেগেই থাকে। এতেও পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের আনাগোনা অনেকাংশে কমে যায়। পর্যটকদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। কুয়াকাটা, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় ভ্রমণস্থান। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে হলে আমাদের পর্যটন শিল্পকে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে।
অপরদিকে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসীদের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের অর্থনীতির চাকা যখন প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল, তখনও ভূমিকা রেখে চলেছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে রাখতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন তারা। অথচ, তাদের যেন দুর্ভোগের নেই সীমা। সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে মানব পাচারের শিকার হন তারা। ন্যূনতম সম্মান দেখানো হয় না তাদের। আইনি জটিলতায় পড়লে ভোগান্তির যেন শেষ নেই। দুঃখজনক হলো, রেমিট্যান্সের পরিমাণও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশের রিজার্ভ কমে এসেছে। যার ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। আমদানি ক্ষমতা কমে এসেছে।
পরিশেষে, আমাদের চ্যালেঞ্জ আছে অনেক। সক্ষমতাও একেবারে কম নয়। অনেক সূচকেই প্রতিবেশী অনেক দেশের থেকে এগিয়ে আছি আমরা। কিন্তু যেতে হবে আরও বহু দূর। দেশ অনেক দিক দিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু সময় ও সম্পদের হিসেবে আমরা আরও অনেকটা আগাতে পারতাম। শুধু প্রয়োজন কল্যাণমূলক নীতি প্রাণয়ণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করা। আর এ কাজে অবশ্যই দেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। নতুন বছর শুরু হোক নতুন প্রত্যয়ে। সততা ঘিরে রাখুক আমাদের প্রতিটি কাজে। আমরা বদলে গেলে দেশ বদলে যাবে। তাহলেই গড়ে তোলা যাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।
খায়রুজ্জামান খান সানি
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া