রেজাউল করিম খোকন: বাজেটে নতুন অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ছয় শতাংশ। অথচ গত মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। তাই বাজেটে মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবভিত্তিক, সেটি যথেষ্ট প্রশ্নসাপেক্ষ। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি যেভাবে কমে আসছে, সেভাবে কমাতে পারছে না এখানে। আমরা আশা করেছিলাম, বর্তমানে দেশে ১২টির মতো সম্পূরক শুল্কের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে। জরুরি কিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হলে তাতে উৎপাদন খরচ কমত। ব্যবসা করার ক্ষেত্রে কাস্টমসের যেসব পদক্ষেপ রয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি বিষয়ে বাজেটে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু সেগুলো কীভাবে ও কবে থেকে বাস্তবায়ন করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপ নেই। আগামী অর্থবছর থেকে একক কোম্পানি ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হয়েছে। এই পদক্ষেপ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে করপোরেট করকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে অনেক কোম্পানি কর প্রদানে আগ্রহী হবে। তবে করপোরেট কর কমানোর সঙ্গে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের যে শর্ত যুক্ত করে দেয়া হয়েছে, সেটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। কারণ বাংলাদেশে এখনও ৮০ শতাংশ অর্থনীতি অপ্রাতিষ্ঠানিক। সেখানে এ ধরনের শর্ত পূরণ করা বেশিরভাগ কোম্পানির ক্ষেত্রেই বাস্তবভিত্তিক নয়। এদিকে করসংক্রান্ত আপিলের ক্ষেত্রে দাবি করা করের ২০ শতাংশ জমার যে বিধান এত দিন ছিল, সেটিকে বাজেটে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, এটা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সিদ্ধান্তটি মোটেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই। এ ধরনের উদ্যোগ নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করে। নৈতিকভাবেও এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের সুযোগ যদি দিতেই হয়, তবে সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ করারোপ করতে হবে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নই প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই। সেটি হলো, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতি, সেখানে বাজেট বাস্তবায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেট বাস্তবায়নের মূল্যায়নটা খুবই জরুরি। তিন মাস পরপর এ ধরনের মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়া দরকার। সমাজ ও অর্থনীতিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায় সময়ে সময়ে পদক্ষেপ বা নীতি গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতাকে মাথায় রেখে বাজেট করার একটি চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। একই সঙ্গে বলতে হয়, নানা খাতে খরচ কমানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে যেন মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই কাজ করেনি। মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বাজেটে দেখতে চেয়েছিলাম, এ বিষয়ে সরকার কী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু সংস্কারপ্রক্রিয়া শক্তিশালীভাবে নেয়া প্রয়োজন। কর খাত, ব্যাংক খাত, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, ব্যবসার খরচ কমানো, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা প্রভৃতি অনেক বিষয়েই বড় সংস্কার দীর্ঘ সময়ের দাবি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর অনেক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ছিল নতুন বাজেটে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট। অপ্রয়োজনীয় সরকারি খরচ কমিয়ে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। এদিকে সুদের হার বাড়ানোর কারণে ব্যবসার ব্যয় বেড়েছে। তাতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ব্যবসার খরচ কমাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। নীতি ও বিধিবিধানের অনিশ্চয়তা, ধারাবাহিকতার অভাব এবং অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হঠাৎ হঠাৎ নীতি পরিবর্তন করাÑএসবই বিনিয়োগকারীদের বড় অভিযোগ। এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই ধীরগতির ও উচ্চ ব্যয়সম্পন্ন। ফলে তা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে খুব বেশি সহায়তা করে না। ঋণপ্রাপ্তির সুবিধার অভাব ও দক্ষ জনবলেরও অভাব রয়েছে। বাজেটে এসব বিষয় সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ দেখতে চেয়েছিলাম। আইএমএফের শর্ত শুধুই নয়, স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ বিদ্যমান শুল্ক ও করছাড় দেয়ার সুবিধা অনেক ক্ষেত্রেই বজায় রাখতে পারবে না। এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন এবং আগামী দু-তিন বছরে এ সুবিধাগুলো কমিয়ে আনতে হবে। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। রাজস্ব বাড়াতে দেশে একটি প্রগতিশীল করকাঠামো থাকা দরকার, যেখানে প্রত্যক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা এবং পরোক্ষ করের ওপর কম নির্ভরশীলতা থাকবে। এ ছাড়া করজাল সম্প্রসারণেও বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যারা কর ফাঁকি দেন বা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তাদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। অন্যদিকে আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো দরকার। বিভিন্ন খাতে যেসব কর অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে, সেগুলোকে যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে সুবিন্যস্ত ও যুক্তিযুক্ত করা কিংবা বাদ দেয়া উচিত। বর্তমান পটভূমিতে উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ানো আবশ্যক। কারণ আমরা যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলছি, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ছাড়া তা অর্জন করা ও টেকসই করা যাবে না। ফলে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের তরুণেরা চাকরির বাজারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রায়ই নিয়োগকর্তারা চাকরির জন্য যোগ্য তরুণদের খুঁজে পান না। ফলে বাজেট হওয়া উচিত শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দও বাড়াতে হবে। দেশের উন্নয়নের গল্পে নীতিনির্ধারকেরা সব সময় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির কথা বলেন। কিন্তু শুধু জিডিপির প্রবৃদ্ধি দিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট কমবে না। তাই নতুন বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে মূল লক্ষ্য না করে বরং সংকট মোকাবিলায় বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আমরা দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে রয়েছি। এ ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বা সম্পদের প্রাপ্যতার পরিমাণও কম। ফলে বাজেট কোনোভাবেই সম্প্রসারণমূলক করা উচিত হবে না। অন্যথায় বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে, তা কাজ করবে না। যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলো দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতির এ সংকটময় অবস্থায় সরকারের প্রশাসনিক ও পরিচালন ব্যয় কমানো প্রয়োজন। এরই মধ্যে দেশের ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যসংকটে ভুগছে। ফলে বাজেট-ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ব্যাংকঋণের পরিবর্তে সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে বাজেট সহায়তা আনার চেষ্টা করতে পারে।
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে কৃষি খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা দীর্ঘ মেয়াদে বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাত কমে যাচ্ছে। এই যে পরিবেশ পরিবর্তন হচ্ছে, মাছ মরে যাচ্ছে, শ্রমিকেরা ধান কাটতে যাচ্ছেন নাÑএমন নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত ফসল রোপণ ও তোলা সম্ভব। এসব খাতে বাজেটে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। স্থানীয় বাজারে নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা রয়েছে। বাজেটে এই জায়গায় নজর দেয়া উচিত ও কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিরূপ আবহাওয়ার জেরে কৃষি খাতের ক্ষতি কমাতে আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। বিশ্বের চাষাবাদযোগ্য ভূমির মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। এই অল্প পরিমাণ আবাদযোগ্য ভূমি নিয়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৭ শতাংশের খাদ্যের সংস্থান করতে হয় বাংলাদেশকে। এর মধ্যে ধান ও মাছসহ কৃষির নানা খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আগামী বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আগামী বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। এখন আর নতুন সড়ক দরকার নেই। সেই টাকা এখন কৃষি খাতে দেয়া উচিত। বাজেটে সরকার কৃষিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, দেশে কম খরচের প্রযুক্তি প্রয়োজন। বিদেশে রপ্তানির জন্য দেশের কৃষি খাত প্রস্তুত হয়নি, আমাদের কোনো অবকাঠামো নেই। কৃষিতে জলবায়ু-সহিষ্ণু প্রযুক্তির বিকল্প নেই। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ৩৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১০০ কোটি ডলারে। তবে গত দুই দশকে দেশে ধান উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার অনেক কমেছে। লাভ কম হওয়ায় ধান উৎপাদনকারী কৃষকেরা বেশি দরিদ্র থাকছেন।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকঋণের সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে আনতে জোর দেয়া প্রয়োজন। পণ্য রপ্তানি বাড়াতে নতুন শিল্প স্থাপনে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দিতে হবে। একই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে আংশিক বন্ডের সুবিধা দেয়া দরকার। তাহলে স্থানীয় অনেক কোম্পানি রপ্তানি করতে সক্ষম হবে। দেশে অনেকের কাছে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ রয়ে গেছে। সেই অর্থ ব্যাংক চ্যানেলে নিয়ে আসতে উদ্যোগ দরকার। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙা করতে বেশ কিছু শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে। এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এর ফলে এসএমই খাতের দিকে বাজেটে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। তাদের কর কমানো দরকার। অন্যদিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনার ক্ষেত্রে দরকার নীতি সহজ করা। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় সংকোচন করা দরকার। এভাবে আগামী দুই বছর চলার পর আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভালো হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিতে হবে। যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব নীতি কাজে লাগছে না দেশে। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে চাকরিবাকরি দরকার। সেজন্য বিনিয়োগ লাগবে। টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে না রেখে ব্যবসা-বাণিজ্যে পুনর্ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। ভূরাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে চীন থেকে অনেক দেশের বিনিয়োগকারী তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছে। এসব বিনিয়োগ থেকে কোন কোন শিল্প আমাদের দেশে আনতে পারি, সে বিষয়ে পরিকল্পনা করা উচিত। পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াতেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ধরা যাক, আগামী পাঁচ বছরে আমরা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে চাই। কোন কোন খাত থেকে এই রপ্তানি আসবে, সেটি প্রথমে চূড়ান্ত করতে হবে। তারপর লক্ষ্য অর্জনে যা যা দরকার, সেসব করতে হবে। যখনই লক্ষ্য অর্জনে সময় দেয়া হয় না, তখন তা ব্যর্থতায় পরিণত হয়ে থাকে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে কর বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা নানাভাবে চাপে আছেন। কর না বাড়িয়ে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বাড়াতে বাজেটে নীতিসহায়তা দেয়া দরকার। সোজা কথা হচ্ছে, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে অর্থনীতি বড় করার মাধ্যমে কর বাড়ানোর পরিকল্পনা নিতে হবে সরকারকে। তাতে উভয় পক্ষের লাভ। অর্থনীতিকে পুরোদমে চাঙা করতে হলে তিন-চার বছরের পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। পাশাপাশি শক্ত পদক্ষেপও লাগবে। ব্যবসায়ীরা যেসব সমস্যার মধ্যে রয়েছেন, সেগুলো সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ দরকার। অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন, রাজস্ব আদায় প্রভৃতি। এগুলোর উত্তরণ ঘটিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকবে। নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেগুলো পূরণের চেষ্টা থাকবে বাজেটে। নিত্যপণ্য যাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান যেন থাকে একটা সীমার মধ্যে, থাকবে এমন চেষ্টাও।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বাজেট-ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা বেশ কমানো হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সহায়ক। এটা সরাসরি মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর পরেও প্রস্তাবিত বাজেটে-ঘাটতি অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা বেশ বড়ই রয়ে গেছে। এ জন্য ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার বড় লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে তা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করবে। ফলে এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরেও চাপ তৈরি করবে। নতুন বাজেটে আরও কিছু বিষয়, যেমন সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, উৎসে করকে ন্যূনতম কর পরিগণনা রহিতকরণ, আর্থিক খাতে বিকল্প উৎস তৈরি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত পরিস্থিতির উত্তরণ, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর কমানো ও সিএমএসএমই খাতের জন্য পৃথক ট্যাক্স কোড গঠনের মতো কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় শিল্পায়ন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, করজাল সম্প্রসারণ ও ঘাটতি মেটাতে আর্থিক খাত-নির্ভরতা কমানোর ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই কঠিন অর্থনৈতিক চাপের মুখেও সময়োচিত বাজেট প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজেট-ঘাটতি যেমন কমানো হয়েছে, তেমনি করহার না বাড়িয়ে করের পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টাও আছে সেখানে। এ ছাড়া সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও মান বাড়ানোর চেষ্টাও আছে। আশা করছি, বাজেটে যে ইতিবাচক উদ্যোগগুলোর কথা বলা আছে, সরকার দ্রুততম সময়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। এটিই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, নতুন বাজেট অগ্নিমূল্যের বাজার থেকে স্বস্তি দেবে। মধ্যবিত্তের আশা, টিসিবির ট্রাকের পেছনে মুখ লুকিয়ে আর দাঁড়াতে হবে না। বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, সবার আশা কি পূরণ করতে পারবে এই বাজেট? টানা দুই বছর মানুষ কষ্ট করছে, তাই আশার আলোর সন্ধানে সবাই। কিন্তু টানেলের শেষে কি আশার আলো দেখা যাচ্ছে?
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক