নতুন ভাইরাস মাঙ্কিপক্স

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ: কভিড মহামারি বিশ্ব থেকে এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই বিশ্বে আরেকটি ভাইরাস জেঁকে বসার উপক্রম করছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ কয়েকটি দেশে একটি ফুসকুড়িসহ জ্বরের ঘটনা ঘটেছে, যা মাঙ্কিপক্স হিসেবে নির্ণয় করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা মাঙ্কিপক্সকে শনাক্তযোগ্য ও বর্ধনশীল ব্যাধি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

মাঙ্কিপক্স একটি ডিএনএ ভাইরাস। কাউপক্স, ভ্যাক্সিনিয়া এবং ভ্যারিওলা (স্ম্যালপক্স) এই গ্রুপের ভাইরাস। এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস যার প্রাথমিক সংক্রমণ সংক্রমিত প্রাণীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বা সম্ভবত তাদের অপর্যাপ্তভাবে রান্না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়। উদাহরণ-জংলী কুকুর, ইঁদুর, খরগোশ, কাঠবিড়ালি, বানর, সজারু  প্রভৃতি। ১৯৫৮ সালে ল্যাবরেটরিতে প্রথম বানরের দেহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম দেখা দিয়েছিল বলে ১৯৭০ সালে এর নামকরণ হয় মাঙ্কিপক্স। এই ভাইরাসের ২টা স্ট্রেইন আছে। কঙ্গো বেসিন স্ট্রেন পশ্চিম আফ্রিকার স্ট্রেইনের চেয়ে বেশি মারাত্মক। এই ভাইরাস পশু থেকে প্রাণী এবং পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণই সবচেয়ে ভয়ংকর মাধ্যম বলে বিবেচিত। ৯০ শতাংশ রোগী ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু। গুটিবসন্তের টিকা বন্ধ করা এর একটি কারণ হতে পারে।

আফ্রিকায় ১-১০ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুর হার রিপোর্ট করা হয়েছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে প্রাদুর্ভাবে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। জটিলতার মধ্যে রয়েছে স্থায়ী ক্ষত, বিকৃত দাগ, সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, কেরাটাইটিস, কর্নিয়ার আলসারেশন, অন্ধত্ব, সেপ্টিসেমিয়া এবং এনসেফালাইটিস। গুটিবসন্তের টিকা মাংকিপক্স থেকে ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। ২ সপ্তাহের মধ্যে, সম্ভব হলে  ৪ দিনের মধ্যে এটি ব্যবহার করতে হবে। ইনকিউবেশন পিরিয়ড গড়ে ১২ দিন, ৪ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত। প্রড্রোম ১ থেকে ১০ দিন স্থায়ী হয়। জ্বরজনিত অসুখের সাথে ঠাণ্ডা লাগা, ঘাম, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য,  ফ্যারিঞ্জাইটিস, শ্বাসকষ্ট এবং কাশি হয়ে থাকে। লিম্ফ্যাডেনোপ্যাথি জ্বরের পরে ২-৩ দিনের মধ্যে ঘাড়ের চারদিকে দেখা যায়। ১ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ফুসকুড়ি তৈরি হয়। ফুসকুড়ি প্রায়ই মুখে শুরু হয় এবং তারপর শরীরের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এটি ২ থেকে ৪ সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে।

এগুলো মুখমণ্ডল, শরীর, হাত-পা এবং মাথার ত্বক জড়িত। হাতের তালু এবং পায়ের পাতায় ক্ষত দেখা যেতে পারে। এগুলি ব্যথাহীন হয়। যদি ব্যথা থাকে তাহলে এটি সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে হতে পারে। চুলকানি থাকতে পারে।

হেমোরেজিক এবং ফ্ল্যাট ফর্ম, যা গুটিবসন্তের সঙ্গে দেখা যায়, মাঙ্কিপক্সের রোগীদের ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না। এই রোগ সাধারণত সেলফ লিমিটেড। আক্রান্ত বা সন্দেহযুক্ত প্রাণীর সংস্পর্শে যাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। প্রাণীর কামড়, আঁচড় এবং লালা বা প্রস াবের স্পর্শ থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য। আর আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে সব ক্ষত শুকানো পর্যন্ত আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টাইন করে চিকিৎসা করা আবশ্যক।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, এফডিএ গুটিবসন্ত বা মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের জন্য উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়ার জন্য একটি লাইভ, নন-রিপ্লিকেটিং স্মলপক্স এবং মাঙ্কিপক্স ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়েছে। সিডোফোভির-মাঙ্কিপক্সের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগস্মলপক্স ভ্যাকসিন, মাঙ্কিপক্স ভ্যাকসিন উভয়ই লাইভ অ্যাটেনুয়েটেড ভ্যাক্সিনিয়া স্ট্রেন থেকে উদ্ভূত।

বাংলাদেশে এখনও এই রোগের কোনো রোগী ধরা পড়েনি। কভিড মহামারিকে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেভাবে মোকাবিলা করেছি, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে যেমনভাবে বাংলাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে দিইনি, সেরকমভাবে আমরা মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের জন্যও প্রস্তুত আছি। দেশের মানুষকে যেকোনো ধরনের গুজব বা আতঙ্ক এড়িয়ে চলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো এই রোগ থেকেও আমরা জাতিকে নিরাপদ রাখতে পারব ইনশাল্লাহ।

উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

পিআইডি ফিচার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০