পরিবারে নতুন অতিথি আসার পর সবার মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ছোট্ট মানুষটিকে নিয়ে যখন পরিবারের সবাই মেতে থাকেন, তখন অনেক মা-ই গোপন করেন নিজের ক্লান্তি, অবসাদ।
সন্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নারী থেকে জন্ম হয় একজন নতুন মায়ের। মাতৃত্বের এ অভিজ্ঞতাকে একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বলা চলে, যা তাকে শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই অনেকটা বদলে দেয়।
সন্তানের আগমন মানে জীবনটাকে নতুনভাবে সাজানো। মাতৃত্বের শুরুর দিনগুলো একই সঙ্গে অনেক আনন্দপূর্ণ এবং ক্লান্তিকর। দিন ও রাতের প্রায় পুরোটা সময় ব্যস্ততায় পার করতে হয়। বলা যায়, ২৪ ঘণ্টাই কাজ। কোনো বিশ্রাম নেই। আপনি কখন আরাম করবেন? তাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে ছোট্ট মানুষটি। কয়েকদিন মাত্র বয়স কিন্তু সারা দিন তার কাজ করতে গিয়েই নাজেহাল অবস্থা হয় নতুন মায়ের। সাহায্য করার কেউ না থাকলে তো কোনো কথাই নেই, ধকল তখন পুরোটা যায় মায়ের ওপর দিয়ে। সঙ্গত কারণে তখন নিজের জন্য সময় বের করা দুরূহ হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে আসে বিষন্নতা। এ সময় কান্না আসতে পারে। মনমরা হতে পারে। সামান্য কারণে রেগে যাওয়া কিংবা হতাশ হওয়ার মতো নানারকম অনুভূতি হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সন্তান জন্মদানের প্রথম দুই সপ্তাহে এমন অনুভূতি অস্বাভাবিক নয়।
একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার পর বিষন্নতায় ভোগেন। ইংরেজিতে একে ‘বেবি ব্লুজ’ বলে। আমাদের দেশের অনেকে হয়ত এ বিষয়টি সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত জানে না। ফলে এর গুরত্বটিও বোঝে না। এ বেবি ব্লুজ সম্পর্কে শুধু নতুন মায়ের একা জানলে হবে না, জানতে হবে পুরো পরিবারকে এবং শিশুর পাশাপাশি নতুন মায়ের প্রতি হতে হবে বিশেষ যত্নশীল। কারণ যত্ন, মনোযোগ, ভালোবাসা ও বিশ্রাম মাকে এ বিষন্নতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
শারীরিক কিংবা মানসিক পরিবর্তন অথবা উভয় পরির্তনের কারণে বেবি ব্লুজ হতে পারে। প্রসবের পরে খুব দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন হয়। এ সময় হরমোন লেভেলের দ্রুত পরিবর্তন, বুকের দুধ তৈরি হওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া ও অতিরিক্ত পরিশ্রম এ শারীরিক কারণগুলোই যথেষ্ট বেবি ব্লুজ হওয়ার জন্য।
মানসিক কারণের মধ্যে থাকতে পারে শিশুর যত্নআত্তি নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকা, নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো নিয়ে দুশ্চিন্তা। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ও নতুন দায়িত্বকে ভয় পাওয়া শুরু হতে পারে। দাম্পত্য জীবনে অশান্তিও দেখা দিতে পারে।
সন্তান জন্মদানের পর একজন মা সাধ্যমতো ছোট্ট শিশুটির সব প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেন। কোনো ত্রুটিই রাখেন না। এ সময় নিজের যত্ন নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ব্রাত্য থেকে যায় তার কাছে। অথচ সন্তানের সঠিক যত্নের জন্য দরকার সুস্থ মা। মায়েরও প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার ও পর্যাপ্ত ঘুম।
হালকা ব্যায়াম মন ফুরফুরে করে। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। বাইরে সম্ভব না হলে হাঁটার জন্য বাসার ছাদ নির্বাচন করতে পারেন। শুনতে পারেন পছন্দের গান। এসবের চেয়ে বেশি জরুরি আপনজনের সান্নিধ্য। আপনজনদের কাছে আপনার অনুভূতি খুলে বলুন, তাদের সুযোগ দিন আপনার যত্ন নেওয়ার। দেখবেন এতে অনেকটাই ভালো বোধ করছেন।
মনে রাখা জরুরি, এ বিষন্নতা সাময়িক। শিগগিরই স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসবেন। তাই ধৈর্য ধরুন। আপনজনের সহায়তা ও ভালোবাসাই আপনার এ বিষন্নতা কাটিয়ে উঠার একমাত্র ওষুধ।
সন্তান জন্মদানের পর দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা চরম বিষন্নতাকে বলে পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন বা প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা। অনেকে ‘পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন’ ও ‘বেবি ব্লুজ’কে একই বিষয় মনে করে থাকেন। কেননা দুটো বিষয়ের লক্ষণগুলো প্রায় কাছাকাছি। এদের মধ্যে পার্থক্য শুধু স্থায়িত্ব ও গভীরতায়। বেবি ব্লুজ সাধারণত প্রসবের পর থেকে শুরু হয়ে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। অপরদিকে পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। এ ধরনের বিষন্নতা মা ও শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে যদি সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা না করা হয়। কারণ পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশনে মা মানসিকভাবে এতই বিষন্নত হয়ে পড়েন যে তখন বাচ্চাকে নিজের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেন। একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন মা এ সমস্যায় ভোগেন। এ সময় অনেক মা আত্মহত্যা করা কিংবা বাচ্চাকে মেরে ফেলার মতো ভয়ানক ভাবনাকেও স্বাভাবিক মনে করেন। বেবি ব্লুজ কোনো মানসিক রোগ না হলেও পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন এক সময়ে মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।
কাজেই বিষন্নতার ধরন বুঝে এর সঠিক চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
সুলতানা রাজিয়া