সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের ভোগ্যপণ্য, ব্যাংক, ট্রেডিং ব্যবসা, বাণিজ্য ও শিল্প খাতের দাপুটে নেতৃত্বের আসনে ছিল চট্টগ্রামের কয়েক ডজন ব্যবসায়ী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় আসলে তখন বিরোধী দলসহ বিপরীত মতাদর্শে অবস্থান করা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতা, মামলা-হামলা, জেল-জুলুম-হয়রানি, ব্যবসা দখল করে নেয়া হয়। এতে কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, কারও দুর্বল হয়ে যায়। ফলে খাতভিত্তিক নেতৃত্বে ছিটকে পড়েন। এসব খাতে তাদের সম্মিলিত বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, শামসুল আলমের এমইবি গ্রুপ, আসলাম চৌধুরীর রাইজিং গ্রুপ, শাহাবুদ্দিন আলমের এসএ গ্রুপ, মাকসুদুর রহমানের আরএসআরএম গ্রুপ, জহির আহমেদ রতনের নূরজাহান গ্রুপ, ইয়াসিন চৌধুরীর এফএমসি গ্রুপ, মিজানুর রহমান শাহীনের সিলভিয়া গ্রুপ, হারুন উর রশিদের এমএইচ গ্রুপ, এসএম ফজলুল হকের চয়েজ গ্রুপ-সহ আরও শতাধিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন করা হয়। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ খেলাপি হয়ে কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, কারও দুর্বল হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মরত একাধিক ব্যাংকের দায়িত্বশীল ব্যাংকাররা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগ ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করে। এ নীতিমালায় স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ মানের ঋণখেলাপিরা বিশেষ এ সুবিধা ঘোষণা দেয়া হয়। অর্থাৎ সব খেলাপির জন্যই বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে। পুনঃতফসিলের পর ঋণখেলাপিরা নিতে পারবেন নতুুন ঋণও। এ নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিল সুবিধা পাবেন। কেস টু কেস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধে এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ প্রথম এক বছরে খেলাপিদের ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। মওকুফ হবে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ ও ইন্টারেস্ট সাসপেন্সেস হিসাবে রক্ষিত সুদও।
তবে জারিকৃত নীতিমালায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন ট্রেডিং (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজ শিল্প, লোহা ও ইস্পাত শিল্প খাতের ঋণখেলাপিরা। এসব খাতের খেলাপি গ্রাহকরা সরাসরি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। অন্য খাতের ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল সুবিধা পেতে ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এসব সুবিধা শুধু আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীরা পেয়েছিলেন। বিপরীত দলের ব্যবসায়ীরা আবেদন করলে তাদের টাকা ঋণের সঙ্গে সমন্বয় করে ঋণ খেলাপি বানিয়ে মামলা দিয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেয়া হয়।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের রোষানলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ নির্মাণ খাতের ব্যবসায়ী এফএমসি ডকইয়ার্ডের চেয়ারম্যান ইয়াসিন চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা হাছান মাহমুদ, হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরেন ফাতেমা, ভাই খালেদ মাহমুদ, সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী, আলাউদ্দিন আহমেদ নাছিম, আ জ ম নাছির উদ্দিনের কাছ থেকে জাহাজ বানানোর অর্ডার নিয়ে বিপদে পড়ে যান। তারা রাষ্ট্রযন্ত্র ও দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নানাভাবে আমাকে হয়রানি করেন। এমন কি আমার ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার সব আয়োজন করে দেয়। এসব কারণে আমাকে দেশ ছাড়তে হয়। আমি এসব বিষয়ের প্রতিকার চেয়ে বর্তমান প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি।
একইভাবে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর মালিকানাধীন পেট্রোরিয়াম রি-ফাইনারি প্রতিষ্ঠান লার্ক পেট্রোলিয়াম দখলে নিয়েছে হায়ান মাহমুদের আত্ময়ীস্বজন। এ বিষয়ে রাইজিং গ্রুপের কর্মকর্তারা বলেন, এ বিষয়ে মামলা আদালতে চলমান আছে। আমরা এসবের সঠিক বিচার চাই।
আরএসআরএমের এমডি মিজানুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, আওয়ামী লীগ লিংক ছাড়া ব্যাংকগুলো লোন দেয়নি, সরকারি দপ্তরগুলোতে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ করেনি, কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলো মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। করোনার সময় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড অন্যায়ভাবে আমাদের কারখানায় সাবস্টেশন বন্ধ করে দিয়েছিল।
এছাড়া এনবিআরসহ সবগুলো সংস্থাকে ব্যবহার করে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। এসব কারণে ইস্পাত খাত, জাহাজ ভাঙা ব্যবসা আমরা করতে পারিনি। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কোথাও প্রতিকার পাইনি। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গিয়ে ব্যবসায় খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমাদের ইস্পাত খাতে হাজার কোটি টাকার বিনিময় অলস পড়ে আছে। আমরা আবার ব্যবসায় ফিরতে চাই। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সরকারের নীতি সাপোর্ট দিয়ে বন্ধ কারখানাগুলো পরিচালনার সুযোগ দিলে আমরা কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থানসহ সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব দিতে পারব?