নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিন

স্নিগ্ধ রূপের মাধুরী ছড়িয়ে শত শত নদ-নদী বয়ে চলেছে লাল-সবুজের বুক চিড়ে। জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। নদীকে ঘিরেই যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। পানি ছাডা আমাদের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। পানি ও পলির উর্বরতায় নদী পাড়ের জমিতে সোনালি ফসল ফলে প্রচুর। বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৩১০টি নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ৫৮টি বড় বড় নদ-নদী প্রবেশ করেছে। এদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য: পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র অন্যতম। পদ্মা নদীর উপনদী হিসেবে মহানন্দা, ইছামতী আর শাখা নদীর মধ্যে রয়েছে ভৈরব, গড়াই, মধুমতি কিংবা আড়িয়াল খাঁ। ইতিহাস বলে, বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সর্বশেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার খালা ঘসেটি বেগমের ঘনিষ্ঠ সহচর রাজা রাজবল্লভের বিশাল রাজপ্রাসাদ ছিল বর্তমান নড়িয়া উপজেলার রাজনগর ইউনিয়নে। দুর্ভাগ্য যে, ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মা নদীর ভয়াবহ আগ্রাসী ভাঙনে রাজা রাজবল্লভের সব কীর্তি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। তখন থেকেই পদ্মার আরেক নাম হয় কীর্তিনাশা। মেঘনা নদীর উপনদীর মধ্যে তিতাস, গোমতী, বাউলাই ও মনু। কর্ণফুলী বাংলাদেশের একমাত্র খরস্রোতা নদী কর্ণফুলী। ব্রহ্মপুত্রের যমুনামুখী ধারা বুকে নিয়েছে দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া এ চার উপনদীর পানি। ব্রহ্মপুত্র বংশী, বানার, শিরকালী ও সুতিয়া নামের ছোট শাখা নদী। প্রতি বছরে প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন টন পলি বয়ে আনে ব্রহ্মপুত্র। মাছে ভাতে বাঙালি আমাদের ঐতিহাসিক ডাক নাম। নদ-নদীতে প্রচুর মৎস্য শিকার করা হয়। আর সেগুলো আমাদের খাদ্য ও আমিষের ৬০ শতাংশের অভাব পূরণে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। দিনদিন দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে এবং খরাপ্রবণতা বাড়ছে। উষ্ণ হয়ে উঠছে আবহাওয়া। এছাড়া ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে সঙ্গে কমছে নদীর সংখ্যাও। বর্তমানে অসংখ্য নদী মরে গেছে, অনেকগুলো মুমূর্ষু। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় বড় নদ-নদীও অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় ধুঁকছে। ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব সংকটে। নদী গবেষকরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে ৭০০ নদী ছিল বাংলাদেশে। এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। এদিকে ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার সর্বত্রই চলছে দখলবাজদের আগ্রাসী থাবা। নদী ভরাট করে তৈরি করছে দালান-কোটা। বিভিন্ন শিল্প এলাকার অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হয় নদীতে। নদীতে বালি উত্তোলন, অতিরিক্ত খনন করে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, নদ-নদীর দখল রোধে উচ্চ আদালতের দেয়া দফায় দফায় নির্দেশনার প্রতি অনেকটা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। জবরদখল থামাতে মাঝে মধ্যে সরকারি পদক্ষেপ নেয়া হলেও নানা ফাঁকফোকর আর সীমাবদ্ধতায় মাঝপথেই তা থমকে যায়। ফলে প্রভাবশালী নদী দখলবাজরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীপথের আয়তন ছিল প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার বর্তমানে এ আয়তন সংকুচিত হয়ে মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে রূপধারণ করেছে। আমরা নদীগুলোকে গলাটিপে হত্যা করেই চলেছি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০২০ অনুযায়ী দেশের সব নদ-নদী, জলাধার, খাল-বিল, সমুদ্র উপকূল, হাওর, বাঁওড়, জলাভূমি, ঝরনা, হ্রদ, অন্যান্য পানির উৎস সবকিছুই এই আইন ও কমিশনের আওতার মধ্যে থাকবে এবং আইন অমান্যকারীকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। দেশের নদী গবেষকরা বলছেন, শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদ-নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। যদি বলা হয়, বাংলাদেশ এখন নদী বিপর্যয়ের দেশ তাহলে ভুল হবে না। নদী বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষর, রাজনীতিক-ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি-সাধারণ মানুষÑসমাজের প্রায় সর্বস্তরের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অবৈধভাবে নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত। এভাবে নদী দখলদারদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে, যাচ্ছে আমাদের নদীগুলো। শিল্প কারখানার বর্জ্য নদীর পানি দূষণের জন্য দায়ী। বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত কলকারখানার দূষিত পানি নদীতে ফেলা হয়; এতে করে নদীতে থাকা জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। সম্প্রতি দেখা গেছে,  তিমিসহ আরও কিছু প্রজাতির মাছ মারা যেতে। এভাবেই নদীর পানি দূষিত হয়ে আমাদের জীববৈচিত্র্য দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে। নদী বাঁচাতে হলে প্রশাসনকে আর বিলম্ব না করে এখনই বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধের সব ব্যবস্থা নিতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে। জলাভূমির লিজ বন্ধ করতে হবে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। সরকার নদীকে ইতোমধ্যে জীবসত্তা হিসেবে বিবেচিত করেছে এ আইন নদী রক্ষার জন্য যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নদীর মালিকানা ও স্বত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার। নদী রক্ষার জন্য বিশেষ কার্যকরী আইনের প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নদী হচ্ছে আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সব নাগরিকদের। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধনে নদী রক্ষা করতে হবে। নদী দখলকারীদের প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। ভবিষ্যতে প্রজন্মের জন্য আমাদের দেশকে গড়ে তুলতে হবে। নদীকে বাঁচাতে হবে, কারণ নদী বাঁচলে বাঁচবে আমাদের দেশ।

মো. তোফাজ্জল হোসেন

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০