ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ দেখে প্রবীণরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। তিস্তা ব্যারাজ পার হওয়ার সময় চিকচিক করতে থাকা বালু দেখে ব্যারাজ তৈরির সময়কার স্রোতের বেগের কথা কেবলই স্মৃতি হয়ে ধরা দেয় স্থানীয়দের মনে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি পারাপারে আটকে গেলে যাত্রীরা যতটুকু বিরক্ত হন, তার চেয়ে কি বেশি কাতর হন না নদীর বুকে চরের সমাহার দেখে? গতকালের শেয়ার বিজে এমনই এক হাহাকার-মেশানো খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সেখানকার ২২টি নদ-নদী এখন বালুচর। প্রতিটি নদীর বুকে রাজত্ব করছে ফসলের ক্ষেত। মাঝখানে এক চিলতে প্রবাহ ছাড়া নদীর বাকি অংশের প্রায় পুরোটাই সমতল ভূমি। নদীমাতৃক বলে দেশটির যে পরিচিতি, তা বুঝি পুরোপুরিই বিলুপ্ত হতে চললো!
ভাবা যায়, এক নীলফামারীতেই ২২টি নদী! অনেক দেশেও কিন্তু এত নদী নেই। নদীর মতো প্রাকৃতিক সম্পদে পুষ্ট দেশটির মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। বড় শহর, বন্দর, নগর সবই তো নদীকে কেন্দ্র করে। সেখানে নদীর এ অবস্থা আমাদের ব্যথিত করে বৈকি। আমাদের নদীগুলোয় প্রাকৃতিকভাবেই চর পড়ার কথা। এর মূল কারণ, এগুলো প্রতি বছর প্রচুর পলিমাটি বয়ে নিয়ে আসে। সুতরাং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবস্থাপনাকে মেলালে চলবে না। নদীর পানির ক্ষেত্রে আমরা প্রধানত ভারতের ওপর নির্ভরশীল। যদিও নদীতে পানিপ্রবাহের বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন রয়েছে; কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি প্রায়ই সেগুলো ভঙ্গ করে। শুধু পলিমাটির প্রবাহের কারণে নয়, পানিপ্রবাহ নিয়ে ভারতের স্বেচ্ছাচারিতায় ভুক্তভোগী আমাদের নদীগুলো। সুতরাং আমাদের নদীব্যবস্থাপনা এমনভাবে সাজানো উচিত, যেখানে আন্তর্জাতিক কূটনীতি থেকে শুরু করে স্থানীয় চাহিদা সবকিছুই সমভাবে গুরুত্ব পাবে। না হলে নদীগুলোকে আর বাঁচানো যাবে না।
নদীর চরকেও যথাযথভাবে ব্যবহার করা জানতে হবে। শুকনো মৌসুমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য চরগুলো থেকে বাড়তি উপার্জনের ব্যবস্থা করা যায় সরকারিভাবে। নদী যাতে দখল না হয়, তাও ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। বর্ষার পানি কীভাবে সারা বছর ধরে রাখা যায়, সে কৌশল উদ্ভাবনও জরুরি। আমরা কোনোভাবেই চাই না আমাদের নদীগুলো আস্তে আস্তে ফসলের ক্ষেত হয়ে যাক; চলে যাক ভূমিদস্যুদের দখলে। স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে যদি নদী ব্যবস্থাপনার কোনো উপায় তৈরি করা যায়, তাহলেই বোধ হয় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকারকেই শুরুতে এগিয়ে আসতে হবে। নদী যেমন বাঁচাতে হবে, তেমনি একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জীবিকাকেও বিকশিত করতে হবে। দুটোর সম্মিলন না ঘটালে নদীর প্রবহমানতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করবো, সরকার এ দিকটিতে বিশেষ মনোযোগ দেবে। দেশের প্রতিটি নদী বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গৃহীত হোক।