কামরুন নাহার মুকুল: কমিউনিটি ক্লিনিকের বারান্দায় পা রাখতেই ওয়াও ওয়াও কান্নার শব্দে পা থেমে যায় রাতুলের; তাকায় এদিক-ওদিক। পরিচ্ছন্নতাকর্মী একগাল হাসি দিয়ে, ‘আপনে বাপ হইছেন আমার বকশিশ…!’ চমকে ওঠে রাতুল; মুখ থেকে কথা বের হয় না। সেবিকা এগিয়ে আসতে আসতে হাসি মুখে, ‘আপনি মেয়েসন্তানের বাবা হয়েছেন। প্রথম সন্তান; মিষ্টি খাওয়াবেন না! আয়া দরজায় দাঁড়িয়ে, ‘চাঁদের মতো সোন্দর মেয়ে হইছে; বকশিশ না দিলে কোলে নিতে দিব না।’ রাতুল বাবা হওয়ার আনন্দে বিভোর। এত খুশির মধ্যেও ভোলেনি নিজের হাত ধোয়ার কথা। এগিয়ে যায় বেসিনের দিকে।
ভালোবাসা আর আদরের মধ্যে নবজাতককে সুস্থ-সুন্দর ও নিরাপদে রাখা নিশ্চিত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। জন্মের পর থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সী শিশুকে নবজাতক বলা হয়। এ সময়টি মা এবং নবজাতক উভয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; শিশুর এবং গোল্ডেন আওয়ার। জšে§র এক মিনিটের মধ্যেই বাচ্চার নাড়ি কাটতে হয়। মায়ের গর্ভের ফুল পড়তে দেরি হলে বা নবজাতকের কাঁদতে দেরি হলেও নাভি কাটা বন্ধ রাখা যাবে না।
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশু তার মাকেই একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাছে পায়। প্রত্যেক মায়ের কাছেও তার সন্তান তার পৃথিবী। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নবজাতককে ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার করে মায়ের সংস্পর্শে দিতে হবে। এক ঘণ্টার মধ্যে মুখে তুলে দিতে হবে মায়ের বুকের শাল দুধ; যা শিশুর প্রথম টিকা, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক এবং সর্বোৎকৃষ্ট খাবার। বাচ্চার মাথা শরীর থেকে একটু উঁচুতে রেখে দুধ খাওয়ালে দুধ সোজা পেটে চলে যায় এবং তাড়াতাড়ি তা শিশুর হজমে সহায়ক হয়।
জন্মের সময় শিশু তার ত্বকে একটি প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর নিয়ে জন্মায়। এটা এমিওনিটিক ফ্লুইড; এর ওপর ভারনিক্স ক্যাসোসা নামে আরেকটি লেয়ার থাকে। এই পাতলা সাদাটে আবরণটি শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভুলেও এ আবরণ ঘসে মেজে কোনোভাবেই তোলা যাবে না। আপনা আপনি ছয়-সাত দিনের মধ্যে এ আবরণ পরিষ্কার হয়ে যায়।
শিশুর থাকার ঘরটিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকা চাই। বিছানা হবে মোটামুটিভাবে আরামদায়ক; তবে বেশি নরম নয়। শিশুকে চিত করে শোয়ালে নাক-মুখ বিছানায় গুঁজে শ্বাস বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। শিশু জন্মের পর শুধু খাবার সময় ছাড়া সারাক্ষণই ঘুমায়। সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে গড়ে তুলতে হলে শিশুকে জাগিয়ে প্রতি দুই-আড়াই ঘণ্টা পর পর দুধ খাওয়াতে হবে। খাওয়ার পর ঢেঁকুর তোলানো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। শিশুর চিবুক কাঁধে রেখে হালকাভাবে পিঠ চাপড়াতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত ঢেঁকুর না তোলে। ঢেঁকুর পেটের অতিরিক্ত বাতাস বের করে দেয়; পাচনেও সাহায্য করে।
কুসুম কুসুম গরম পানিতে নরম কাপড়ের টুকরো চুবিয়ে হালকাভাবে চেপে পানি ঝরিয়ে বাচ্চার চোখের ময়লা পরিষ্কার করতে হবে; ভুলেও খালি হাতে খোটাখুটি করা যাবে না। কোনো কোনো শিশুর চোখ থেকে পানি পড়তে দেখা যায়। নরম কাপড়ে বারবার চোখ মুছে নিলে এ সমস্যা এক-দু’মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবে বেশি সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া বাঞ্ছনীয়।
নাজুক, কোমল ও সংবেদনশীল নবজাতকের শরীর খুব সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শিশুর সংস্পর্শে আসার আগে সাবান কিংবা জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ বা ইনস্ট্যান্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। যে কেউ শিশুকে কোলে নেয়ার আগে তাকেও একই পরামর্শ দিতে হবে। এমনকি শিশুর প্রস াব-পায়খানা করা কাঁথা-কাপড় পাল্টাবার আগে হাত পরিষ্কার করে শিশুকে স্পর্শ করা এবং পরেও হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।
শিশুর নখ খুব দ্রুত বাড়ে; নখের আঁচড় তার ত্বকে লাগতে পারে। আঁচড় গভীর হলে ঘা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ঘুমন্ত অবস্থায় তার ছোট্ট নখগুলো সুন্দর করে কেটে দিতে হবে; নখ শক্ত হলে গোসলের পরেই কাটা উত্তম। যে নেইলকাটার, ব্লেড বা কাঁচি ব্যবহার করা হবে, তা জীবাণুনাশক মেশানো পানিতে ধুয়ে নেয়া জরুরি।
দুধ খাওয়ার কারণে শিশুর জিহ্বায় সাদা আস্তর পড়ে যায়; পরিষ্কার নরম শুকনো কাপড়ে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হবে শিশুর জিভ। শিশুর কান ও নাক পরিষ্কারের ব্যাপারে সতর্ক থাকা একান্ত জরুরি। কান এবং নাকের ভেতর কটনবার দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে না। নরম সুতি কাপড়ের কোনা পেঁচিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে কান; একইভাবে বের করে নিতে হবে নাকের ময়লা। তাতে কান বা নাকে আঘাতের কোনো আশঙ্কা থাকে না। নাক সর্দি বা ময়লা জমে বন্ধ হলে শিশু মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় এবং দুধ টানতে চায় না।
শিশুর প্রজনন অঙ্গ অনেক বেশি নরম ও কোমল। ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর প্রজনন অঙ্গ যত্ন ও পরিচ্ছন্নতায় পার্থক্য রয়েছে। মেয়েশিশুকে ভেজা নরম পরিষ্কার কাপড় দিয়ে সামনে থেকে পেছনে নিয়মিত পরিষ্কার করে বেবি অয়েল লাগিয়ে দিতে হবে।
ছেলেশিশুর যৌনাঙ্গের ব্যাপারেও যত্নশীল হতে হবে। পেনিসের মাথায় চামড়ার নিচে ময়লা জমে যায়; ভেজা নরম কাপড়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
সাধারণত সাত থেকে ১৪ দিনের মধ্যে নাভি শুকিয়ে আপনা আপনি ঝরে যায়। শিশুর নাভিতে কোনো রকম তেল, ঘি ও ওষুধ লাগানো যাবে না। নাভি পুরোপুরি না শুকানো পর্যন্ত যাতে পানি না লাগে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। চিকিৎসকরাও সাধারণত নাভি না শুকানো পর্যন্ত শিশুকে গোসল করাতে বারণ করেন; শরীর মুছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। এত ছোট্ট শরীরÑযার দু’হাতে ধরাই মুশকিল, তাকে গোসল করানোর সময় দু’কানের ছিদ্রতে তুলা গুঁজে নিয়ে সমতল জায়গায় কাঁথা বা তোয়ালে বিছিয়ে শিশুকে শুইয়ে নরম কাপড় হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে চিপে শিশুর মাথা মুছে অতঃপর নরম শুকনা কাপড়ে মাথা ও শরীর মুছে দিতে হবে। মাথা ভেজা থাকলে ঠান্ডা লাগার আশঙ্কা থাকে। এরপর গলা, বুক ও হাত মুছে দিতে হবে। জšে§র ৩ দিনের মধ্যে কোনোভাবেই শিশুকে গোসল করানো যাবে না।
সকালের সূর্যের আলো শিশুর হাড়ের জন্য খুবই উপকারী। শিশুর মাথা, চোখ ও মুখে রোদ না লাগে লক্ষ্য রেখে মুখের নিচ থেকে পুরো শরীরে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ মিনিট রোদ লাগালে শিশু সহজেই ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে পারে। শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার টিকা। শিশুর প্রথম টিকাটি হলো যক্ষার টিকা; যা জন্মের ১৪ দিনের মধ্যে দিতে হয়। তা না হলে দেড় মাস বয়সে। নবজাতকের টিকা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, ততই মঙ্গল।
নবজাতককে এভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ভেতরে সুরক্ষিত রাখলে সর্দি, কাশি, ডায়রিয়া, নাভির সংক্রমণসহ অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা খুবই সহজ। সবাই সচেতন থাকি আর যত্নে থাকুক আমাদের প্রজন্ম। বেড়ে উঠুক সে আমাদের সবার ভালোবাসা, পরিচ্ছন্নতা আর সচেতনতায়।
পিআইডি নিবন্ধ