নবজাতকের যত্ন

নাহিদ আলম: পরিবারে নতুন শিশু মানেই যেন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের আগমন। জন্মের পর থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত বয়সের শিশুকে নবজাতক বলা হয়। তবে যতটা আনন্দ, ততটা দুশ্চিন্তাও থাকে নবজাতককে ঘিরে। দুশ্চিন্তা শিশুর সঠিক পরিচর্যা নিয়ে, দুশ্চিন্তা শিশুর সুস্থতা নিয়ে। আর এ বিষয়টি থেকে মুক্তি পেতে নবজাতকের সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে জানা একান্ত প্রয়োজন।

নবজাতকের পরিচর্যার জন্য প্রথম যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো প্রসূতী মায়ের পরিচর্যা। একজন গর্ভবতী মা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছেন কি না দেখতে হবে। কারণ গর্ভবতী মায়ের এ পুষ্টির ওপর অনাগত শিশুর শরীরের পুষ্টি নির্ভর করবে। গর্ভবতী মাকে গর্ভাবস্থায় শান্ত পরিবেশ দেয়া হচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। কারণ মা যদি চাপযুক্ত জীবনযাপন করেন, তার প্রভাব গর্ভে থাকা শিশুর ওপর পড়বে। এ সময় একজন গর্ভবতী নারীকে নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে পুরা গর্ভাবস্থায় অন্তত চারটি চেকআপ করাতে হবে। এ চারটি চেকআপ করে দেখতে হবে গর্ভে থাকা সন্তানের কোনো সমস্যা হলো কি না। শিশু ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না। শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো তৈরি হয়েছে কি না। গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস অথবা উচ্চ রক্তচাপ অথবা খিঁচুনিজনিত কোনো রোগ তৈরি হলো কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে গর্ভবতী মায়ের নিয়মিত চেক আপের মাধ্যমে। উল্লিখিত বিষয়গুলোর প্রতিটি গর্ভে থাকা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মায়ের জ্বর বা প্রস্রাবে সংক্রমণ হলো কি না, সে বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।

শিশুর জš§ যেন ভালোভাবে ও সুস্থভাবে হয়, সেজন্যও আমাদের কিছু করণীয় আছে। আমাদের ভেতর প্রায়ই একটি ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে সন্তান প্রসব করানোর বিষয়ে। অনেকে বাসায় প্রসব করাতে চান, হাসপাতালে প্রসব করাতে চান না। শিশুর জন্মগ্রহণ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ দাই বা ধাত্রীর হাতে হওয়া উচিত। কারণ সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা, যেমন সন্তান জন্ম নেয়ার পর হঠাৎ বার্থ ট্রমা, অথবা জন্ম নেয়ার পর শিশু শ্বাস নিতে না পারা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিষয়টি ধরতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত সঠিকভাবে চিকিৎসা করাতে পারলে মা ও শিশু দুজনের জীবনই বেঁচে যাবে। সংকট এড়াতে হাসপাতালে সন্তান প্রসব করানো উচিত।

জন্মের পরবর্তী যে মিনিট, তা হলো গোল্ডেন মিনিট। এই এক মিনিটের মধ্যে বাচ্চার যদি কোনো শ্বাসকষ্ট বা নিঃশ্বাসের কষ্ট না হয়, তাহলে বাচ্চাটা আজীবন ভালো থাকবে এমনটা ধরে নেয়া হয়। এই এক মিনিট থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে শিশুটি যদি শ্বাস না নেয়, তবে শিশুর মারাত্মক নিউরোলজিক্যাল রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দ্বিতীয় যেটি হলো, হাসপাতালে শিশু জন্মগ্রহণ করার পরপরই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখা হয় এবং সেটি হলো, শিশুর শরীরের তাপমাত্রা, যা নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ জন্মের পরপরই মায়ের জরায়ুতে থাকা পানিতে শিশু ভিজে থাকে। এ পানি যদি ভালোভাবে মুছে দেয়া না হয়, তাহলে নবজাতকের ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ।

শিশুর জন্মের পরপরই গোসল করিয়ে দেয়ার বিষয়টি এখনও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত রয়েছে। জন্মের পরপরই শিশুকে গোসল করানো যাবে না এবং তা করানো যাবে না অন্তত তিন থেকে চার দিন। জন্মের পর আস্তে আস্তে শরীর মুছে দিতে হবে। আবার জন্মের পরপরই দেখা যায় অনেক নবজাতককে মধু খাওয়ানো হয়। আসলে এটি কিন্তু একটি ভ্রান্ত ধারণা। শিশুর জন্মের পর প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে দেয়া উচিত নয়, এমনকি পানিও নয়। জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। সিজার করা শিশুকেও এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। শিশুর জম্মের পরে প্রথম ও একমাত্র কাজ হলো মায়ের প্রথম দুধ বা শালদুধ শিশুকে খাওয়ানো। শালদুধ শিশুর জন্য প্রথম টিকা হিসেবে কাজ করে এবং শিশুকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। শালদুধ পরিমাণে কম হলেও শিশুর জন্য যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ পুষ্টি জোগায়। শালদুধ খাওয়ালে শিশুর রাতকানা, জন্ডিস ও অন্যান্য রোগ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। শালদুধ খাওয়ালে মা ও শিশু দুজনই সুস্থ থাকে। শিশুকে পূর্ণ ছয় মাস পর্যন্ত কেবল মায়ের বুকের দুধই পান করানো উচিত, যা শিশুর পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিতের প্রথম ধাপ।

নবজাতকের যত্নে জন্মের পর নবজাতককে নরম কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মুছে পরিষ্কার করে নিতে হবে। গরমের সময় শিশুকে মোটা কোনো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা উচিত নয়। তাতে শিশু অস্থির হয়ে যেতে পারে। শিশুকে হালকা নরম কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখলেই চলবে। প্রয়োজন হলে ঘরে ফ্যান বা এসি চালানো যেতে পারে।

নবজাতকের স্বাভাবিক ওজন হলো ২ দশমিক ৫ কেজি। জন্মের সময় শিশুর এই ওজনের চেয়ে কম হলে বা কোনো সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।

জন্মের পর থেকে ২৮ দিন বয়সী নবজাতককে যে ঘরে রাখা হয়, অনেকে সেই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখে। এটা করা কখনোই ঠিক নয়। নবজাতক ও মাকে যে ঘরে রাখা হয়, সেই ঘরের দরজা-জানালা খোলা রাখা উচিত, যাতে বাইরের আলো-বাতাস ঘরে আসতে পারে।

বাইরে থেকে কেউ এসেই নবজাতককে যেন কোলে তুলে না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত, কারণ বাইরে থেকে কেউ এলে তার শরীরে অনেক ময়লা ও জীবাণু থাকতে পারে। শিশুকে হাত দিয়ে ধরার ফলে সেগুলো নবজাতককে আক্রান্ত করতে পারে। তাই বাইরে থেকে এসেই নবজাতককে কোলে না নেওয়া উচিত। আর যদি নিতেই হয়, তাহলে কোলে নেওয়ার আগে ব্যবহার করতে পারেন জীবাণুনাশক হ্যান্ডওয়াশ অথবা ইনস্ট্যান্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজার। আর তা না হলে সাবান দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নবজাতককে নেয়া উচিত। শিশুর ডায়াপার বা প্রস্রাব-পায়খানা করা কাপড় ও কাঁথা পাল্টানোর পরে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

শিশুদের নখ খুব দ্রুত বাড়ে। ওই নখের আঁচড় শিশুর ত্বকে লাগতে পারে। আঁচড় গভীর হলে ঘা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শিশুর জšে§র পর নিয়মিত সুন্দর করে কেটে দিতে হবে তার ছোট্ট নখগুলো। শিশু ঘুমিয়ে গেলেই শিশুর নখ কাটতে হবে, তাহলে নড়াচড়ার কারণে কেটে যাওয়ার ভয় থাকে না। আর জেগে থাকা অবস্থায় নখ কাটতে চাইলে কারও সাহায্য নেয়া ভালো। তবে খুব বেশি চেপে ধরা ঠিক নয়, কারণ শিশুর নখ সাধারণত নরমই থাকে। তবে শক্ত মনে হলে গোসলের পর শিশুর নখ কাটা যেতে পারে।

শিশুর শরীর মালিশ করা তাদের জন্য উপকারী। এটি শিশুকে ঘুমাতে সাহায্য করে এবং রক্ত সঞ্চালন ও হজম বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। শিশুকে গোসল করানোর আগে হাতে অল্প পরিমাণে বেবি অয়েল বা লোশন নিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করলে শিশুর শরীরের ব্লাড সার্কুলেশন ভালো হয় এবং এতে শিশু আরাম অনুভব করে। এতে শিশুদের ঘুমেও ভালো প্রভাব পড়ে।

নবজাতকের পোশাক নির্বাচনে বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। গরমে শিশুর জন্য সুতি কাপড়ের পোশাক নির্বাচন করা উচিত, কারণ সিনথেটিক বা মোটা কাপড় ব্যবহারে শিশুর ত্বকে র‌্যাশ বা অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুকে পোশাক পরানোর আগে ও ডায়াপার বাছতে গিয়ে খেয়াল রাখতে হবে, তা আরামদায়ক উচ্চ শোষণক্ষমতাসম্পন্ন কি না এবং তাতে কোনো পোকা বা ময়লা আছে কি না। শিশুর জন্য নতুন কেনা পোশাক ও চাদর ব্যবহারের আগে সবসময় অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে। পোশাক জীবাণুমুক্ত করার জন্য মৃদু ও কোমল ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা উচিত।

সুস্থ ও হাসিখুশি নতুন অতিথি কে না চায়? তাই নবজাতকের সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে জন্ম থেকেই তার যত্ন নেয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০