Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 5:59 pm

নবজাতকের সংক্রমণ

খালেদা বেগম: সারারাত ধরে কাঁদল আয়েশার ৪ দিন বয়সী শিশুটি। প্রথম তিন রাতও কাঁদল অনেক। পরে ঘুমাল, অল্প করে মায়ের বুকের দুধ খেল। কিন্তু গত রাতে কী যে হলো, শিশুটির ঘুম আর খাওয়া তো দূরের কথা, সারারাত থেকে থেকে চিৎকার। গায়ের তাপমাত্রার ওঠানামা তো ছিলই। সকালে হাসপাতালের ডাক্তার এলো দেখতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ল, নবজাতকের সেপসিস হয়েছে।

সেপসিস হলো রক্তের সংক্রমণ, যা শিশুর জšে§র পর হতে ৩ মাসের মধ্যে হয়ে থাকে। শিশুর ফুসফুস, পাকস্থলী, মূত্রনালি অথবা ত্বকও এ সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে। সংক্রমণে জড়িত ব্যাকটেরিয়া এবং এগুলো থেকে উৎপাদিত বিষাক্ত পদার্থ নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হƒদস্পন্দন ইত্যাদির মাত্রাতিরিক্ত ওঠানামার মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সঠিকভাবে কাজে বাধা প্রদান করে। এর ফলে কিডনি, ফুসফুস, মস্তিষ্ক অথবা হƒদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সের নিচে যত শিশু মারা যায় তার অর্ধেকেরও বেশি মারা যায় জন্মের প্রথম মাসের মধ্যে এবং এ মৃত্যুর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ঘটে সংক্রমণ বা সেপসিসের কারণে।

নবজাতকের জ্বর যদি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট অথবা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়, সেইসঙ্গে যদি মাকে দুর্বলতা, নিস্পৃহ, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, অনিয়মিত হƒদস্পন্দন এবং ত্বকের রং পরিবর্তনের মতো লক্ষণ এবং যদি শিশু বিরতিহীনভাবে কাঁদে তবে অবশ্যই বুঝতে হবে এগুলো সেপসিসের লক্ষণ। ফলে অভিভাবককে সতর্ক হতে হবে ও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এর বাইরেও ডায়রিয়া, পেট ফোলা, গায়ে র‌্যাশ ওঠা এবং বমি হওয়াও শিশুদের জন্য বিপদের লক্ষণ। জন্মের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর শরীরে সংক্রমণ দেখা দিলে শিশুকে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।

বিভিন্ন কারণে শিশুর সেপসিস হতে পারে। শিশুর মা সংক্রমণের জীবাণু বহন করলে, গর্ভধারণের ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার পূর্বে শিশু জন্ম গ্রহণ করলে, প্রসবের সময় মায়ের ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপর জ্বর থাকলে, শিশু জন্মের ১৮ ঘণ্টা আগে মায়ের গর্ভের পানি ভেঙে গেলে এবং  জন্মের  সময় বাচ্চার ওজন আড়াই কেজির কম হলে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গর্ভকালে মা যদি ভেজালযুক্ত অথবা কমসিদ্ধ অথবা অপরিচ্ছন্ন খাদ্য গ্রহণ করে, তবে তাতে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়া শিশুর মায়ের জরায়ু বা প্রজননতন্ত্রে রয়ে যায় এবং প্রসবকালে শিশু জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে।

অপরিচ্ছন্ন হাতে নবজাতককে স্পর্শ করলে ময়লা কাপড় পরিধান করে শিশুকে কোলে নিলে বা চুমু খেলে, সে সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। জন্মের প্রথম কয়েক দিন সাধারণত বাড়িতে বা হাসপাতালে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অনেক দর্শনার্থী শিশুকে দেখতে আসে, অনেকে অপরিচ্ছন্ন অবস্থাতেই শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করে, যা নবজাতকের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, নবজাতককে স্পর্শ করার বিষয়ে শুধু বাইরের দর্শনার্থীরাই নয় বরং পরিবারের সবাইকে এমনকি তার মাকেও অত্যন্ত সতর্ক ও পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।

অপরিচ্ছন্ন ও অস্বাস্থ্যকর প্রসবের স্থান মা ও শিশু, উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসবের কারণে নবজাতকের সংক্রমণের হার বেশি। এছাড়া শিশুর ধমনিতে দীর্ঘসময় ক্যাথেটার লাগানো থাকলে বা দীর্ঘদিন হাসপাতালে অবস্থান করলেও শিশুর সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।

সেপসিস বা সংক্রমণ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। শিশুর জন্মের প্রথম ৭ দিনের মধ্যে সংক্রমণ হলে তাকে বলা হয় ‘প্রারম্ভিক সংক্রমণ’, যা প্রসবের সময় শিশু মায়ের কাছ থেকেই পায়। তাই এ ধরনের জীবাণু বহনকারী মাকে প্রসবকালে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদানের মাধ্যমে শিশুকে সংক্রমণমুক্ত রাখার চিকিৎসা দেয়া হয়।

বিলম্বিত সংক্রমণ হয় শিশুর জন্মের ৭ দিন থেকে ২ মাসের মধ্যে। এ ধরনের সংক্রমণের কারণ

সম্পর্কে ধারণা করা হয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অপরিচ্ছন্ন সংস্পর্শকে দায়ী করা হয়। তাই নবজাতকের জন্য স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

চিকিৎসার অংশ হিসেবে আক্রান্ত শিশুর শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য তাকে হাসপাতালের বিশেষ পরিচর্যা শাখার উষ্ণ বিছানা বা ইনকিউবেটরে রাখা হয়। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, হƒদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি-প্রকৃতি বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এ সময় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হলে তাকে অক্সিজেন দেয়া হয়।

শিশুর সেপসিস হলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসা চলতে পারে ৭ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত। সংক্রমণের চিকিৎসার অন্যতম উপায় হলো অ্যান্টিবায়োটিক। নবজাতকের পাকস্থলী থেকে তার শরীর ঠিকমতো অ্যান্টিবায়োটিক শোষণ করতে পারে না বিধায় স্যালাইনের সাহায্যে তা দেয়া হয়। এছাড়া তার শরীরের পানিশূন্যতা রোধ ও ঘুমজনিত কারণে কম খাদ্য গ্রহণ ও ঘাটতি মোকাবিলায় স্যালাইন ও দেয়া হয়। অনেক সময় নবজাতকের সংক্রমণ হলে নাকে নল ঢুকিয়ে শিশুকে দুধ খাওয়ানো হয়।

‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিওনেটাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি ২০০৯’-এ শিশু মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমানোর লক্ষ্যে নবজাতকের সংক্রমণের সুব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এর ফলে ১৯৯০ সালে যেখানে ১ হাজার শিশুর মধ্যে ১৪৪ জনই পাঁচ বছর বয়সের আগে মৃত্যুবরণ করত, সেখানে ২০১২ সালে এ হার কমে প্রতি হাজারে ৪১ জনে নেমে আসে। এর ফলে বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের আগেই সহস্রাব্দ লক্ষ্য মাত্রার ৪নং লক্ষ অর্থাৎ শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসে সফল হয়।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) ২২ নভেম্বর, ২০২০ সালের এক জরিপ প্রতিবেদনের  তথ্য বলেছে, বাংলাদেশে এখনও হাজারে ৪০টিরও বেশি শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে নবজাতকের (২৮ দিন বয়স পর্যন্ত) মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে ৩০টি। পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এ মৃত্যুহার হাজারে ৪৫।

‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিওনেটাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি-২০০৯’-এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), এসএনএল-সেভ দ্য চিলড্রেন, বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটি এবং আইসিডিডিআর,বিসহ আরও কিছু দেশীয় বেসরকারি সংস্থা। সফলতার এ প্রবণতা ধরে রেখে শিশুমৃত্যুর হার আরও কমানোর লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে নবজাতকের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং সুচিকিৎসায় সচেষ্ট হতে হবে। তবে সবার আগে সংক্রমণরোধে পরিবারের সদস্যদের সচেতনতার এ ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধন