Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:33 am

নবজাতক ও শিশুর সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নাগরিকদের করণীয়

ডা. মোহাম্মদ হাসান জাফরী: আইনগতভাবে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন মানুষকে শিশু বলা হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা শিশু হিসেবে বিবেচনা করি। আর জšে§র পর থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত শিশুকে নবজাতক হিসেকে গণ্য করা হয়। নবজাতকসহ অন্য শিশুদের সংক্রামক রোগ বিশেষভাবে পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তাদায়ক। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের রোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এদের তিন ভাগের এক ভাগ মারা যায় ডায়রিয়া রোগে, এক ভাগ ছয়টি প্রতিরোধযোগ্য সংক্রামক রোগে এবং বাকি এক ভাগ অন্যান্য রোগে। তাই সংক্রামক রোগগুলো প্রতিরোধ করতে পারলে শিশুমৃত্যু অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। শিশুদের সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শিশুদের যক্ষ্মা, পোলিও মাইলাইিটস, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, নবজাতকের ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বিজনিত রোগ, হাম, রুবেলা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ইত্যাদি।

যক্ষ্মা একটি মারাত্মক রোগ, যা মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। নবজাতক ও শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপরিপক্ব থাকে বলে তাদের ক্ষেত্রে এ রোগ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ, আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি ও থুথুর মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এ রোগে আক্রান্ত হলে অল্প অল্প জ্বর ও কাশি হয়, ক্ষুধা কমে যায়, শিশু দুর্বল হয়ে যায়, গ্রন্থি ফুলে যায়, পরে পেকে গিয়ে সে গ্রন্থি বগল বা ঘাড়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে। অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে ওজন কমে যায়। যে কোনো হাড়ের জোড়া ফুলে যায় এবং অচল হয়ে যায়। মেরুদণ্ডে যক্ষ্মার ফলে মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায় এবং ব্যথা হয়। মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে তাকে টিবি মেনিনজাইটিস বলে; শিশুর মারাত্মক মাথাব্যথা, অচেতনতা, ঘাড় শক্ত ও খিঁচুনি হয়। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হতে পারে এবং রোগ ছড়াতে পারে। জন্মের পরপরই যত শিগগির সম্ভব বিসিজি টিকা দিলে তা শিশুর দেহে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জন্মের পর পর বিসিজি দেয়া না হলে, শিশুর এক বছর বয়সের মধ্যেই এই টিকা গ্রহণ করা উচিত।

পোলিও রোগটি বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিলুপ্ত হলেও এ রোগের ব্যাপারে সবার সচেতনতা খুবই প্রয়োজন; কারণ এটি শিশুদের ভাইরাসজনিত পঙ্গুত্বের জন্য দায়ী। আক্রান্ত শিশুর মল দ্বারা দূষিত পানি খেলে বা আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শে এলে এ রোগ হতে পারে। শুরুতে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সর্দি, কাশি এবং সামান্য জ্বর হয়। এরপর মাথাব্যথা করে, ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, জ্বর থাকে, শিশুর হাত অথবা পা অবশ হয়ে যায়, শিশু দাঁড়াতে চায় না, উঁচু করে ধরলে আক্রান্ত পায়ের পাতা ঝুলে পড়ে, দাঁড়া করাতে চাইলে শিশু কান্নাকাটি করে এবং নড়াচড়া করতে পারে না, শিশুর আক্রান্ত অঙ্গ ক্রমশ দুর্বল হয় এবং পরে স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশি অবশ হয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে শিশু মারাও যেতে পারে। এক মাস পর তিন ডোজ এবং হামের টিকা দেয়ার সময় আরও একবার অর্থাৎ মোট চারবার পোলিও টিকা শিশুর এক বছর বয়সের ভেতরে খাওয়ানো হলে তা শিশুর দেহে পোলিও রোগ প্রতিরোধ করে। প্রথম ডোজ দেয়ার সবচেয়ে ভালো সময় শিশুর ৬ সপ্তাহ বয়স।

ডিপথেরিয়া রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার নাম করাইনেব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরি। ডিপথেরিয়া রোগাক্রান্ত শিশুর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ওই জীবাণু যখন সুস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করে তখন এই রোগ দেখা দিতে পারে। শিশু খুব সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ রোগে আক্রান্ত শিশু ঠিকমতো খায় না এবং খেলাধুলা করে না, শিশুর জ্বর, সর্দি ও কাশি দেখা দেয়, গলা ফুলে যায় এবং কণ্ঠনালি বা গলদেশের ভেতরে সাদা আস্তরণ পড়ে। পরবর্তী সময়ে শিশু খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে, কণ্ঠনালির গ্রন্থিগুলো খুব বেশি ফুলে যায়, কণ্ঠনালিতে ধূসর রং এর সুস্পষ্ট আস্তর পড়ে এবং আস্তরটি শ্বাসনালিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি করে। এ রোগ হƒৎপিণ্ড এবং স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে এবং শিশুর মৃত্যু ঘটাতে পারে। শিশুর জšে§র এক বছরের মধ্যে ২৮ দিন বা এক মাস পরপর তিন ডোজ টিকা দিলে তা শিশুকে ডিপথেরিয়া থেকে রক্ষা করে। বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। প্রথম ডোজ টিকা দেয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হলো শিশুর ছয় সপ্তাহ বয়সে।

বড়ডেটলা পারটুসিস নামক ব্যাকটেরিয়া শিশুর হুপিংকাশির জন্য দায়ী। হুপিংকাশিতে আক্রান্ত শিশু হাঁচি কাশি দেয়ার সময় বাতাসের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায় এবং আক্রান্ত শিশুর সংস্পর্শেও এ রোগ ছড়ায়। প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত শিশুর জ্বর হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে, চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়, কাশি দেখা দেয়। দ্বিতীয় সপ্তাহে কাশি মারাত্মক আকার ধারণ করে। শিশু যখন কাশে, তখন তার খুব কষ্ট হয় এবং চোখ স্ফীত ও লাল হয়ে যায়। কাশির পর শিশু হুপ শব্দ করে শ্বাস নেয়। অনেক সময় বমিও হয়। ছয় মাসের কম বয়স্ক শিশু হুপ শব্দ ছাড়াও কাশতে পারে এবং বমি করতে পারে। যদি কাশি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলে, তাহলে হুপিংকাশি বলে অনুমান করা যেতে পারে। হুপিংকাশির ফলে শিশু দুর্বল হয়ে যায় এবং অপুষ্টিতে ভোগে। শিশুর নিউমোনিয়া হতে পারে শিশুর চোখে রক্ত জমাট বেঁধে অন্ধ হয়ে যেতে পারে। শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। শিশুর এক বছর বয়সের মধ্যে ২৮ দিন বা এক মাস অন্তর তিন ডোজ টিকা দিয়ে শিশুকে হুপিংকাশি থেকে রক্ষা করা যায়।

বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ৬ মাস বয়সের মধ্যেই শিশু মারাত্মকভাবে হুপিংকাশিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে; সে কারণে ৬ সপ্তাহ বয়স থেকেই এ টিকা দেয়া শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।

ধনুষ্টংকার শিশু ও নারীদের একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের জীবাণুর নাম ক্লস্ট্রিডিয়াম টিটানি। পশুর মলের মাধ্যমে নির্গত এই রোগের জীবাণু মাটির সঙ্গে থাকে। এই রোগের জীবাণু কাটাস্থান দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। শিশুর জšে§র পর অপরিষ্কার জীবাণুযুক্ত ছুরি বা ব্লেড দিয়ে নাড়ি কাটলে বা নাড়িতে গোবর বা ময়লা কাপড় ব্যবহার করলে নবজাতক শিশুর ধনুষ্টংকার রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত শিশু জšে§র ৩-২৮ দিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং বুকের দুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়, শিশুর মুখ ও চোয়াল শক্ত হয়ে যায় এবং জোরে কাঁদতে পারে না। শিশুর খিঁচুনি হয় এবং শরীর পেছনের দিকে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যায়। নবজাতকের ধনুষ্টংকার শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। এ রোগের চিকিৎসা করা অত্যন্ত কষ্টকর। এ রোগে আক্রান্ত নবজাতক প্রায়ই মারা যায়। তাই প্রতিরোধই উত্তম। গর্ভবর্তী ও সন্তান ধারণক্ষম সব মহিলাকে যথাসম্ভব ৫ ডোজ টিটি টিকা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দিয়ে নবজাতকের ধনুষ্টংকার রোধ করা যায়। এছাড়া নিরাপদ প্রসব ও নাভি কাটার জন্য জীবাণুমুক্ত ব্লেড ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকারের ইপিআই কর্মসূচিতে পেন্টা ভ্যাকসিনের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

শিশুদের হাম একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা মিসেলস ভাইরাস দিয়ে হয়। হামে আক্রান্ত শিশুর কাছ থেকে এই রোগের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে সুস্থ শিশুর শরীরে প্রবেশ করে এবং হাম রোগ সৃষ্টি করে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুর বেশি জ্বর, সর্দি, কাশি হয়। চোখ লাল হয়ে যায় এবং চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে। জ্বর কমে আসার পর মুখে এবং শরীরে লালচে দানা দেখা দেয়। হামের ফলে শিশু নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। কান পাকা রোগ হতে পারে। শিশুর রাতকানা রোগ দেখা দিতে পারে, এমনকি চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। হামের নানা জটিলতার কারণে অনেক শিশু মারাও যায়। শিশুর ৯ মাস বয়স পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে এক ডোজ হামের টিকা দিলে সে হাম রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবে। পুষ্টিহীন শিশুরা হামের পর মারাত্মক রোগ পরবর্তী জটিলতার সম্মুখীন হয়। পুষ্টিহীন শিশুদের পুষ্টিকর পরিপূরক খাবার দিলে তা তাদের হাম-পরবর্তী অন্যান্য রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। (বাকি অংশ আগামীকাল)

পিআইডি নিবন্ধ