নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ছিল রাজনৈতিক

আরাফাত রহমান: ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধ আট ঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব পরাজিত হন। এ যুদ্ধের ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৫০-এর দশকের প্রথম থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করে। বাংলার মোগল শাসকরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বসবাসের অনুমতি দেন এবং বছরে মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার পায়।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শায়েস্তা খানের পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা কলকাতায় বসবাস করার অধিকার পায় এবং কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে প্রথম জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজরা কলকাতায় উইলিয়াম নামে একটি দুর্গও নির্মাণ করে।

জমিদারি কেনা ও ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য খুবই সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়। এরই মধ্যে বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহারের দরুন বাংলার নবাবদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। একই সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীরা বাণিজ্যের ছাড়পত্র তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু করে। কোম্পানি আরও অধিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টায় মোগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের কাছে ধরনা দেয়। তিনি ১৭১৭ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা দেন। এসব সুবিধার মধ্যে ছিল শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় #টাঁকশাল স্থাপন এবং শর্তসাপেক্ষে ৩৮টি গ্রাম কেনার অধিকার। যেহেতু অন্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হতো, আর ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। নবাব মুর্শিদকুলী খান ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন। তিনি উপলব্ধি করেন, কোম্পানির এ বিশেষ সুবিধার ফলে সরকার তার আইনানুগ বাণিজ্য শুল্ক ও টাঁকশালের ওপর প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হবে।

১৭৫৬ সালের এপ্রিলে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতারোহণের সঙ্গে সঙ্গে নবাব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। নবীন নবাব প্রথমবারের মতো বাংলায় কোম্পানির অবৈধ কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানান। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার তিনটি প্রধান অভিযোগ ছিলÑঅনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়ামে প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার, ব্যক্তিগত অবৈধ ব্যবসা এবং নবাবের অবাধ্য প্রজাদের বেআইনিভাবে আশ্রয় দান। এসব অভিযোগের মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নিতে নবাব ব্রিটিশদের আহ্বান জানান এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের জন্য কলকাতায় অনেক প্রতিনিধিদল পাঠান।

নবাবের বিশেষ দূত চিঠি নিয়ে কলকাতায় গেলে ইংরেজরা তাকে অপমানিত করে। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক যে চরম অপমানজনকভাবে নবাবের প্রতিনিধি নারায়ণ সিংহকে বিতাড়িত করে, তা সবিস্তার শুনে নবাব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। নবাব তৎক্ষণাৎ কাসিমবাজার কুঠি অবরোধের আদেশ দেন। কুঠির প্রধান আত্মসমর্পণ করেন, কিন্তু কলকাতার ইংরেজ গভর্নর অবাধ্যতা ও একগুঁয়েমি প্রদর্শন করেন। ফলে নবাব কলকাতা অভিযান করে তা দখল করে নেন। এ পরাজয়ের পর বাংলায় কোম্পানির পুনঃপ্রতিষ্ঠা দুই উপায়ে করা সম্ভবপর ছিলÑহয় নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ, নয়তো পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বল প্রয়োগ।

বাংলায় যেসব ব্রিটিশ ছিলেন তারা অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে জরুরি খবর পাঠান। সেখান থেকে রবার্ট  ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল  ওয়াটসনের অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলীনগরের সন্ধি করতে বাধ্য হন।

কিন্তু ইংরেজরা সন্ধির শর্ত অগ্রাহ্য করতে থাকায় যুদ্ধের চাপা উত্তেজনা চলতে থাকে। তারা নবাবের প্রতি বিরূপ পারিষদদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মুর্শিদাবাদ দরবারে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। নবাবকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করেন। তবে ব্রিটিশরা সক্রিয়ভাবে এ ষড়যন্ত্রে জড়িত না হলে আদৌ কোনো পলাশী বিপ্লব সংঘটিত হওয়া হয়তো সম্ভব হতো না।

ক্লাইভও মাদ্রাজ থেকে যাত্রার আগে লেখেন, নবাবের বেশিরভাগ পারিষদই তার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন। এতে প্রতীয়মান হয়, নবাব দরবারের বিরূপ মনোভাবই ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ কূটচালে লিপ্ত হতে  প্ররোচিত করে এবং এতে করে পলাশীতে চরম আঘাত হানার ষড়যন্ত্র ত্বরান্বিত হয়। ক্লাইভ ও  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দরবারি ঐতিহাসিক ওর্ম, যিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলায় অবস্থান করেন, উভয়ে কর্নেল স্কটের বাংলা দখল করার পরিকল্পনার বিষয়ে অবগত ছিলেন।

রবার্ট ওর্মের কাছ থেকে জানা যায়, নবাবের প্রতি মীরজাফরের অসন্তুষ্টির বিষয়ে জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। ওয়াটস কলকাতার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং নবাব দরবারের প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ওয়াটস কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি উমিচাঁদের কাছে ইয়ার লতিফের নবাব হওয়ার ইচ্ছা সংগোপনে প্রকাশ করেন এবং আরও জানান, দিউয়ান রায় দুর্লভ রাম ও প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক জগৎ শেঠ তাকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাটি লুফে নেন এবং তা ক্লাইভকে জানান। এটি ক্লাইভের অনুমোদন লাভ করে।

৩০ মে পর্যন্ত মীরজাফর মুর্শিদাবাদে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ওয়াটস তার সঙ্গে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থ হন। অবশেষে ৫ জুন ওয়াটস লাল ও সাদা চুক্তিনামায় মীরজাফরের স্বাক্ষর আদায়ে সক্ষম হন, যা ছিল উমিচাঁদকে ধোঁকা দেয়ার জন্য মিথ্যা চুক্তি। চুক্তিস্বাক্ষর সত্ত্বেও পরিকল্পিত বিপ্লব বাস্তবায়নের জন্য সিলেক্ট কমিটি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। কেননা আরও বিলম্ব হলে নওয়াবের কাছে ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়ে যাবে এবং মীরজাফরকে সরিয়ে দেয়া হবে; ফলে গোটা পরিকল্পনা ভণ্ডুল হবে এবং ব্রিটিশরা একা সম্মিলিত দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মাঠে থাকবে। তদনুসারে ১৩ জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

১৯ জুন ক্লাইভ কাটোয়া পৌঁছেন। স্থানটি পূর্বদিন কর্নেল কুট দখল করে নেন। ২১ জুন ক্লাইভ সমর পরিষদের সভা ডাকেন এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্লাইভ পরে সিদ্ধান্ত পাল্টান এবং পরদিন অগ্রসর হওয়ার জন্য মনস্থ করেন। ২২ জুন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রা করে। অবশ্য ওই দিন দুপুরের পর পরই ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বার্তা পান এবং পলাশীর পথে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে দুপুর রাতের পর সেখানে পৌঁছেন।

ইতোমধ্যে নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীর মদন, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের অধীনে নবাব সেনারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়; অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভরামের অধীন নবাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি অবলোকন করে। এমনকি বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটেনি। ক্লাইভ এমন প্রতিরোধ পাবেন আশা করেননি। জানা যায়, দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু বেলা ৩টায় কামানের গোলা মীর মদনকে আঘাত হানে এবং এতে তাঁর মৃত্যু হয়।

মীর মদনের মৃত্যুতে হতভম্ব নবাব মীর জাফরকে ডেকে পাঠান এবং তার জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মীরজাফর নবাবকে ওই দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেন, আর এ খবর শিগগির ক্লাইভের কাছে পৌঁছানো হয়। পরামর্শমতো নবাবের সেনানায়কেরা পিছুতে থাকলে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং ফলে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। অপরাহ্ণ ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদে যাত্রা করেন।

ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তীকালে পলাশী বিপ্লব ইংরেজদের দ্বারা শুধু উদ্ভাবিত ও উৎসাহিতই হয়নি, বরং যুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তারা দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ব্রিটিশ পরিকল্পনা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করে। ইংরেজরা ষড়যন্ত্রের জোরে ও সিরাজউদ্দৌলার সভাসদদের বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ পলাশীতে বিজয়ী হয়। নবাবের পরাজয় মূলত ছিল রাজনৈতিক, সামরিক নয়।

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০