ইসমাইল আলী: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সঙ্গে নবীনগরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে ২০১৮ সালের আগস্টে নেয়া হয় নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। তবে প্রকল্প গ্রহণকালে সড়কটির সঠিক অ্যালাইনমেন্ট চিহ্নিত করা হয়নি। এতে প্রকল্পটির আওতায় জমি অধিগ্রহণ, মাটির কাজ, কালভার্ট নির্মাণ, রক্ষাপ্রদ কাজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন সবকিছুতেই রয়েছে ত্রুটি। আর এ ভুল পরিকল্পনায় নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
সম্প্রতি প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব ত্রæটি সংশোধনে প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর ভুল পরিকল্পনার পেছনে প্রকল্পটির ত্রæটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ভুলের জন্য দায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সয়েল অ্যান্ড ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ারস’ কনসালটিং ফার্মের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং কালো তালিকাভুক্তির সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার জন্য সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের ব্যাখ্যা তলব ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পিএসসি বৈঠকে জানানো হয়, প্রকল্পটির আওতায় ১৪ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ এবং তিন দশমিক ৯২ কিলেমাটির সড়ক প্রশস্ত ও মজবুত করার কথা রয়েছে। তবে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সড়কটি নির্মাণে যে অ্যালাইনমেন্ট ধরা হয়েছিল, তা কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতে জমি অধিগ্রহণসহ সব খাতেই কাজের পরিমাণ ও ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
তথ্যমতে, প্রকল্পটির আওতায় ১৮ দশমিক ৭৩ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কথা ছিল। আর মাটির কাজ করার কথা ছিল ৯ দশমিক ৭৪ লাখ ঘনমিটার। আর এ দুই খাতে বরাদ্দ রয়েছে যথাক্রমে ৬০ কোটি ২২ লাখ টাকা ও ৩০ কোটি ৯ লাখ টাকা। তবে পরবর্তীকালে এ পরিকল্পনায় ভুল ধরা পড়ে। সংশোধিত পরিকল্পনায় জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন ৩৪ দশমিক ৯৬ হেক্টর। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৩৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় সড়কের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া ও অ্যালাইমেন্ট পরিবর্তনের কারণে মাটির কাজ বেড়েছে আট কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটার। এতে মাটির কাজে ব্যয় বেড়েছে ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পটিতে ৯টি কালভার্ট নির্মাণ করার কথা ছিল। তবে সংশোধিত পরিকল্পনায় কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে ২৩টি। এতে বাড়তি ১৪টি কালভার্ট নির্মাণে অতিরিক্ত চার কোটি ৯৬ লাখ টাকা লাগবে। এছাড়া প্রকল্পটিতে ১২ হাজার ৬০০ মিটার ব্রিক টো-ওয়াল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার মূল্য সাত কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ৯ হাজার ৬৫২ মিটার ব্রিক টো-ওয়াল নির্মাণ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে পাঁচ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।
প্রকল্পটিতে এক লাখ ২৬ হাজার বর্গমিটার সিসি বøক কাজের সংস্থান ছিল, যার মূল্য ধরা ছিল ৩১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বাস্তবে এক লাখ ১৬ হাজার ১১৮ বর্গমিটার সিসি বøকের কাজ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে ৩৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বাড়বে দুই কোটি ১৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পে সড়কের অ্যালাইমেন্ট বরাবর পাশের নদী ও গভীর পুকুর থাকায় এক হাজার ৫২০ মিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে হবে। এতে ব্যয় হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
এর বাইরে প্রকল্পে ৫৫০ মিটার আর সিসিইউ ড্রেন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ড্রেন নির্মাণ দরকার দুই হাজার ৪০০ মিটার। এজন্য ব্যয় হবে দুই কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এছাড়া ৯০০ মিটার সসার ড্রেন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যার ব্যয় ধরা ছিল ৩৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে অতিরিক্ত ৭৫০ মিটার সসার ড্রেন নির্মাণ প্রয়োজন। এজন্য অতিরিক্ত দরকার ২৭ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পটির আওতায় পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে সাত লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে দরকার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ কাজে চার লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে দরকার এক কোটি টাকা। আর রোড মার্কিংয়ে ৭৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও অতিরিক্ত ৩৩ লাখ টাকা দরকার। সব মিলিয়ে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে ২৭৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বা ৬৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির বিভিন্ন ভুলের বিষয়ে পিএসসি বৈঠকে উষ্মা প্রকাশ করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দায়ী সয়েল অ্যান্ড ফাউন্ডেশন ইঞ্জিনিয়ারস’ কনসালটিং ফার্মের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা। এছাড়া প্রয়োজনে ওই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সওজ অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
পাশাপাশি পরামর্শক কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে প্রকল্প প্রণয়ন ও দায়িত্বে অবহেলার জন্য অধিপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে সওজ থেকে মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা পরিলক্ষিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশনাও দেয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পর প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধনের বিষয়ে পরবর্তী পিএসসি সভা আহ্বানের নির্দেশনা দেয়া হয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সবুর শেয়ার বিজকে বলেন, নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পটির বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলমান আছে। এরপর প্রকল্পটি সংশোধনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।