শুভ্র শচীন, খুলনা: প্রতিবছর অক্টোবর থেকে বঙ্গোপসাগরের দুবলার চরে শুঁটকি তৈরির মৌসুম শুরু হয়। ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকায় এবার নভেম্বর থেকেই তা শুরু হচ্ছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত খুলনা, মোংলা, রামপাল, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ উপক‚লের কয়েক হাজার জেলে শুঁটকি তৈরির জন্য সাগরপাড়ে অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলবে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবীরাও আসে এখানে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান জানান, আগামী ১ নভেম্বর থেকে মৌসুমের শুরুতেই রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে বন বিভাগ। মোংলা থেকে নদীপথে দুবলা জেলেপল্লির দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। সুন্দরবনসংলগ্ন এ পল্লির সব কর্মকাণ্ড জেলেদের ঘিরে। সুন্দরবন অভ্যন্তরের ১৩টি মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র নিয়ে গঠিত দুবলা জেলেপল্লি। শুঁটকি তৈরির জন্য এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের দুবলা, আলোরকোল, মেহের আলী, শ্যালার চরসহ বেশ কয়েকটি চর তারা পরিদর্শন করেছেন বলেও জানান তিনি।
জেলেদের অভিযোগ, দুবলার চরে যাওয়ার পথে ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে দস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে থাকেন তারা। তাই চলতি মৌসুমে জেলেরা যাতে সাগরে নির্বিঘেœ মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরি করতে পারেন, সেজন্য প্রশাসনকে নজরদারি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী জেলে-মহাজনরা।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলেদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে কাজ করেছে বন বিভাগ। আবেদনগুলো যাচাই চলছে, এরপরই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এ মাসেই জানানো হবে জেলেরা কতগুলো শুঁটকি প্রক্রিয়ার ঘর বা সাভার তৈরি করতে পারবেন। এমনকি ঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কতটুকু হবে, তাও বলে দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে দুবলা ফিশারম্যান গ্রæপের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন জানান, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস ও জলদস্যুদের উৎপাতের আতঙ্ক মাথায় নিয়েই উপক‚লীয় অঞ্চলের মৌসুমি জেলেরা জাল-নৌকা ও মাছ আহরণের উপকরণ নিয়ে সাগরপাড়ের জেলেপল্লিতে ছুটবে। জেলেদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দফতর) জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহাম্মদ আলী চৌধুরী জানান, সুন্দরবন এবং সাগর এলাকায় সব সময় দস্যু দমন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে শুঁটকি আহরণের জন্য জেলেদের বাড়তি নিরাপত্তা দিতে আরও কঠোর থাকবে কোস্টগার্ড বাহিনী।
বাংলাদেশ ফিশ ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোল্লা সামছুর রহমান শাহীন জেলেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে বলেন, বঙ্গোপসাগরসহ গোটা সুন্দরবন এখনও ছোট-বড় বনদস্যু বাহিনীর দখলে। তিনি শুঁটকি মৌসুমে জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন।
এদিকে মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রযাত্রাকে ঘিরে উপক‚লের জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে নানা আমেজ বিরাজ করছে। এসব পরিবারে স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় আচারের হরেক রকম আনুষ্ঠানিকতাও চলছে। আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত এ মৌসুম চলার কথা রয়েছে।
প্রতিবছর এ মৌসুমে সাগরপাড়ের দুবলা, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, চাপড়া খালীরচর, কোকিলমনি ও হলদাখালী চরে হাজার হাজার জেলে জড়ো হয়। এসব চরে অবস্থান নিয়ে জেলেরা সমুদ্র মোহনায় মৎস্য আহরণ করে। দুবলা জেলেপল্লির জেলেরা সেখানে নিজেদের থাকা ও শুঁটকি তৈরির অস্থায়ী ঘর তৈরি করে। তারা সমুদ্র মোহনায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারের পর তা শুঁটকি করে। দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা সুন্দরবনের দুবলারচর।
বাঙালির অত্যন্ত পছন্দের খাবার এ শুঁটকি মাছ। বিভিন্ন জেলার মানুষের নিয়মিত খাবার তালিকায় এখন শুঁটকির ভর্তাসহ নানা পদ থাকেই। শুঁটকি মাছ শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। রফতানি হচ্ছেও বিদেশে। বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করে এত থেকে আয় করা সম্ভব বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।