জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: পোশাক পণ্যের স্যাম্পল বা নমুনা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু রপ্তানি হয়েছে পোশাক। এক, দুই টাকার নয়Ñ প্রায় ৪০০ কোটি টাকার পোশাক পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো টাকা আসেনি। রপ্তানির আড়ালে এই টাকা পাচার করেছে চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রাথমিক তদন্তে অর্থ পাচারের বিষয়টি ওঠে এসেছে। তবে রপ্তানির আড়ালে চারটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার নিয়ে যৌথভাবে অনুসন্ধান করবে কাস্টমস গোয়েন্দা ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টাস্কফোর্সের ১০ম সভায় যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের বিভিন্ন ত্রুটির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ত্রুটির কারণে পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থপাচার হয়েছে। ত্রুটি নিরসনে সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করার বিষয়ে সিদ্ধান হয়েছে। এছাড়া অনিয়ম রোধে চট্টগ্রাম বন্দরের এক্সিট গেটে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
সূত্রমতে, গত ৪ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে ‘বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের’ দশম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন। সভায় টাস্কফোর্স সংক্রান্ত কমিটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এতে ১৩টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একটি হলো রপ্তানির আড়ালে চারটি প্রতিষ্ঠানের ৪০০ কোটি টাকা পাচারের যৌথ অনুসন্ধান করা। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং দুদক যৌথভাবে চারটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার অনুসন্ধান করবে।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রমতে, চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পোশাকের স্যাম্পল বা নমুনা দেখিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলোÑ সাবিহা সাকি ফ্যাশন, এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ও ইলহাম করপোরেশন। এসব প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৭৮০টি চালানের বিপরীতে ১৮ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে; যার ঘোষিত মূল্য ৩ কোটি ৭৮ লাখ ১৭ হাজার ১০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাবিহা সাকি ফ্যাশন মোট ৮৬টি চালানের বিপরীতে ৯৯৭ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে মেন্স ট্রাউজার, টি-শার্ট, বেবি সেট, ব্যাগ, পোলো শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট ও হুডি রপ্তানি করে। এর বিনিময় মূল্য ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৭ মার্কিন ডলার বা ২১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির টি-শার্ট ও লেডিস ড্রেস রপ্তানির কথা থাকলেও বেবি ড্রেস, জিন্স প্যান্ট, লেগিন্স, শার্ট ও শালসহ ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য রপ্তানির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব পণ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে।
এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন ১ হাজার ৩৮২টি চালানের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছে। ১৪ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন টি-শার্ট, টপস ও লেডিস ড্রেস রপ্তানি করেছে, যার বিনিময় মূল্য ২ কোটি ৫৮ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ মার্কিন ডলার বা ২৮২ কোটি টাকা। ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ২৭৩টি পণ্য চালান রপ্তানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন টি-শার্ট, ট্রাউজার ও টপস রপ্তানি করে, যার বিনিময় মূল্য ৬৫ লাখ ৪ হাজার ৯৩২ মার্কিন ডলার বা ৬২ কোটি টাকা। ইলহাম করপোরেশন ৩৯টি চালান রপ্তানি করেছে। ৬৬০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, ট্যাংক টপ, লেডিস ড্রেস প্রভৃতি রপ্তানি করে, যার বিনিময় মূল্য ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৫ মার্কিন ডলার বা ১৭ কোটি টাকা।
কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, চারটি প্রতিষ্ঠান বিল অব এক্সপোর্টে দিনের পর দিন ব্যবহার করেছে ভুয়া এলসি আর ইএক্সপি নম্বর। এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক এক ব্যাংকের গ্রাহক। আর এলসি এবং ইএক্সপি অন্য ব্যাংকের। অথবা রপ্তানিকারক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের-ই গ্রাহক। কিন্তু ব্যবহার করা হয়েছে অন্য গ্রাহকের এলসি আর ইএক্সপি নম্বর। বিল অব এক্সপোর্টের হার্ডকপি আর কাস্টমসের সার্ভারের তথ্যেও মিলেছে বিরাট ফারাক। যার অন্যতম রপ্তানিকারকের নামের ভিন্নতা। গরমিল আছে ন্যাচার অব ট্রানজেকশন, সিপিসি কোড আর ইউডিতেও।
সূত্রমতে, টাস্কফোর্সের দশম সভায় এই চারটি প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকি ও অর্থ পাচার যৌথ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই অনুসন্ধান করবে। সভায় কাস্টমসের গোয়েন্দার প্রতিনিধি এই চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যের ‘স্যাম্পল’ বা নমুনা ঘোষণার আড়ালে ৪০০ কোটি টাকা পাচারের বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই টাকা বিদেশে পাচার করেছে। তবে সভায় সিআইডি প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে বিভিন্ন ত্রুটি রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সিআইডি এই সফটওয়্যারের ত্রুটিগুলো সংশোধনের বিষয়ে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছিল। সফটওয়্যারটি নির্দিষ্ট সময় পর পর পর্যালোচনাপূর্বক ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীকরণের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম বন্দর হতে আমদানি করা পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে ‘এক্সিট’ গেটে শুধু বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করেন। এক্সিট গেটে বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীর পাশাপাশি অন্যান্য আইন-প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে আমদানির ক্ষেত্রে অনিয়ম অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। আলোচনা শেষে সভাপতি অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যারটি নিয়মিতভাবে আপডেট ও চট্টগ্রাম বন্দরের এক্সিট গেটে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে নজরদারির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য এনবিআর ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়ার বিষয়ে মতামত প্রদান করেন। চিঠির খসড়াটি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তিনি বিএফআইইউকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো হতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন।
অপরদিকে, সভায় দুদক প্রতিনিধি কাস্টমস গোয়েন্দা চারটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং মামলা করা হয়েছে কি না, জানতে চান। পরে কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিনিধি বলেন, কাস্টমস আইনে মামলা করা হলেও মানিলন্ডারিং মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ বিষয়ে দুদক প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, এ ধরনের মামলায় সাধারণত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট থাকে বিধায় দুদকের সমন্বয়ে যৌথ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়। দুদক আইন অনুযায়ী, অনুসন্ধান ও এফআইআরের পর মামলার বিধান রয়েছে বিধায় অন্য সংস্থার দায়েরকৃত মামলায় দুদকের সমন্বয়ে যৌথ তদন্তকারী দল গঠন করা হলে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তিনি এ সংক্রান্ত মামলায় মানিলন্ডারিং মামলার আগেই দুদক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়ে যৌথ অনুসন্ধানকারী দল গঠনের বিষয়ে আহ্বান জানান। সভায় উপস্থাপিত কাস্টমস গোয়েন্দার চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং অনুসন্ধানের জন্য দুদক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার সমন্বয়ে যৌথ অনুসন্ধান দল গঠনের বিষয়ে সভাপতি মতামত প্রদান করেন। এছাড়া তিনি যেসব মামলায় একাধিক সংস্থার শিডিউলভুক্ত অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় সেসব মামলায় মানিলন্ডারিং মামলার আগেই যৌথ অনুসন্ধান দল গঠনের জন্য বিএফআইইউকে অনুরোধ করার বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দেন।