বন-জঙ্গলে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ কিংবা ছন্দের সঙ্গে মিল রেখে একসঙ্গে খাওয়া থেকে হয়তো চড়–ইভাতির উৎপত্তি হয়েছে। শিশুদের সংগ্রহ করা চাল-ডাল দিয়ে রান্না করে খাওয়া চড়ুইভাতি এ থেকেই ছোট্টবেলার ভুলকাভাত। ভোঁ-দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে ‘পুষ্ণা’র বায়না। পুষ্ণা শব্দটিও নতুন প্রজন্মের কাছে অচেনা। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে, এলাকাভেদে নাম পুষ্ণা, পুষলা, পুষলি, পুষালি বা পুষরা। অর্থ পৌষে একদল কিশোর বাড়ি থেকে চাল, ডাল, ডিম, হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে কোনো খোলা জায়গা অথবা গাছের নিচে বসে রান্না করে খাওয়া।
কালক্রমে চড়ুইভাতি থেকে বনভোজন বা পিকনিকের প্রচলন এসেছে। কালে কালে বনভূমিতে গিয়ে প্রীতি সম্মিলনে বা প্রীতি উৎসবের সঙ্গে চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে রূপ পেয়েছে প্রীতিভোজনের। ভোজনের পর বিচিত্রানুষ্ঠান। প্রীতিপ্রদ উৎসবের নাম এভাবেই হয়ে যায় ‘বনভোজন’।
পিকনিক বা বনভোজন নিয়ে কথার শেষ নেই। অনেকের মতে, বনভোজনের সঙ্গে বাঙালিকে প্রথম পরিচিত করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘অচলায়তন’ নাটকে কবিগুরু নতুন শব্দ তুলে ধরেন বনভোজন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে আশালতা আর বিনোদিনীর সেই শান্ত-সুন্দর পিকনিকের বেলা হৃদয়ে গেঁথে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র একটি দৃশ্যে পিকনিকে খেলতে বসে মেমোরি গেম দৃষ্টিনন্দন হয়ে আছে।
বাঙালির জীবনে বনভোজন এখন তো শীত মৌসুমের প্রীতি উৎসবে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচিত্র অনুষঙ্গ। দর্শনীয় স্থান পর্যটন এলাকা, কিংবা প্রাকৃতিক নিসর্গের কোনো স্থানে দলবল নিয়ে ভ্রমণে গিয়ে একদিন বা কয়েক দিন অবস্থান করে পিকনিকের প্রতিপদ আমেজ পেয়েছে। কখনও সবাই মিলে পিকনিকের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এমন প্রীতির সম্মিলনে অনেকের ডেটিং পর্ব, প্রণয় পর্ব চলে। বিবাহিতরা ফিরে পান তারুণ্যের রোমান্টিসিজমের ক্ষণ। এ বনভোজনকে শিক্ষা সফর হিসেবে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর বিশেষ করে শীতকালে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বনভোজন বা শিক্ষা সফরের আয়োজন করে।
বনভোজনের অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষে এসেছে ‘রন্ধনপূর্বক ভোজন’। পরে অভিধানে বিস্তৃত বর্ণনায় বলা হয়েছে বন বা রম্য স্থানে গিয়ে সংঘবদ্ধ রন্ধন, প্রীতিভোজন। শীতকালে স্থানীয় অধিবাসীরা বিশেষ করে মহল্লাবাসী একদিন তরিতরকারি, চাল-ডাল নিয়ে কোথাও গিয়ে রান্না করে খাওয়ার আয়োজন করত। দল ছোট হলে জোগাড় করা হতো ডিম, মুরগি। আর বড় হলে চাল, ডাল, সবজি, ছোট খাসির গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো দূরে কোথাও বা বড় কোনো গাছের নিচে। চুলা খুঁড়ে খড়ি জ্বালিয়ে শুরু হতো প্রাক-রন্ধনপর্ব। একদল রাঁধত, অন্য দল হৈহুল্লোড়, রংতামাশায় মেতে উঠত। কাছে নদী বা জলাশয় থাকলে ডুবসাঁতারও চলত। কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে অংশ নিত নারী-পুরুষ সবাই। উচ্ছ্বাস-আনন্দের পালায় একসঙ্গে মিলে প্রীতিভোজন ছিল মহা-আনন্দের। খাওয়া-দাওয়া হতো কলাপাতায়।
পিকনিক প্রথার শুরু ১৬৯২ সালের দিকে। তখনকার দিনে কয়েকজন মিলে শীতকালে কোনো সরাইখানায় গিয়ে খানাপিনা করত, পরে যুক্ত হলো আড্ডা। এ পিকনিক ছিল শুধু রাজকীয় আয়োজনে। পরে সাধারণ মানুষ বিকল্প আয়োজন শুরু করে।
পিকনিকের আঁতুড়ঘরের ফরাসি বিপ্লবের রাজপুরুষরা ফ্রান্স ছেড়ে পালিয়ে অস্ট্রিয়া প্রুশিয়া আমেরিকায় জড়ো হয়। বেশিরভাগ পাড়ি দেয় ইংল্যান্ডে। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন ঘুরে পিকনিক চলে আসে ইংল্যান্ডে। ১৭৬৩ সালে লেডি মেরি কোক বোনকে লেখা চিঠিতে পিকনিক পার্টির কথা উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ডে একত্রে বসে খাওয়ার ‘পিকনিক সোসাইটি’র উদ্ভব ঘটে। ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে পিকনিক ছিল সামন্ত প্রভুদের এস্টেটের আউটডোরে খাওয়া-দাওয়ার অলস অবসর। পরে মধ্যবিত্তের জীবনে আসে পিকনিক অবকাশ। ইনডোরের বদলে আউটডোরে পিকনিক হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।
‘একদিন দল বেঁধে ক’জনে মিলে যাই ছুটে খুশিতে হারিয়ে…’ মান্না দে’র কণ্ঠের জাদুকরি গান মনে করিয়ে দেয়। চড়ুইভাতি, ভুলকাভাত, পুষ্ণা, বন-জঙ্গলের প্রীতি সম্মিলনে প্রীতিভোজ কিংবা পিকনিক। দেশে দেশে পিকনিক প্রীতিপ্রদ চিরন্তন উৎসব হয়ে গেছে। বাঙালির বনভোজনকাল পৌষে যাত্রা করে বসন্তের অনেকটা সময় ধরে চলে, রূপ নিয়েছে শীত-বসন্তের প্রীতি উৎসবে। বিদেশে চেরি ফুলের আনন্দের সঙ্গী হয়েছে পিকনিক।
গ্রামীণ পরিবেশের সেই ছোট্টবেলার চড়–ইভাতি আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় চড়–ইভাতি হারিয়ে যাচ্ছে বনভোজন, পিকনিক আর শিক্ষা সফরের ভিড়ে। তবুও শীতকালে নস্টালজিক করে তোলে চড়–ইভাতি। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে চড়–ইভাতির আসল নামকরণ ও বিশেষত্বটা তুলে ধরা উচিত। এতে বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষা ও ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে হাজার বছর ধরে।
রফিক মজিদ, শেরপুর