নাইলোটিকার প্রজনন বেশ সহজ, সাধারণ ও স্বল্পব্যয়ী। প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এ মাছ। আজ এর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো
ব্যবসার জন্য চাষকৃত পুকুর থেকে চাষ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পোনা তৈরি নানা কারণে বিঘিœত হতে পারে। তাই প্রজননের জন্য বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এক্ষেত্রে হ্যাচারি উত্তম মাধ্যম হতে পারে। নাইলোটিকার প্রজনন বা পোনা উৎপাদনের নানা পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো
পুকুরে প্রজনন
পুকুরে নাইলোটিকার প্রজনন বেশ সহজ, সাধারণ ও স্বল্পব্যয়ী পদ্ধতি। তবে প্রজননের পুকুরটি যেন মাছের অনুকূলে থাকে, অর্থাৎ শত্রুমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া পুকুরে পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছের সংখ্যানুপাতিক হারে মজুত করতে হবে। যেমন, প্রজনন পুকুরে প্রতি এক হাজার বর্গমিটারে ২৫ থেকে ৩০টি পর্যন্ত পরিপক্ব মাছ মজুত করা যেতে পারে। প্রজননের উদ্দেশ্যে মজুতে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ৩:১ হারে হওয়া উচিত। এ পুকুরে ২০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য পানির গভীরতা ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটারে সীমিত রাখা দরকার। ব্যবস্থাপনা সঠিক নিয়মে হলে মজুতের ২১ দিনের মধ্যে উন্নত প্রজনন আশা করা যায়।
ধানক্ষেতে প্রজনন
ধানক্ষেতে মাছ চাষ আধুনিক পদ্ধতি। এই স্থানে চাষ করা মাছের অধিকাংশই নাইলোটিকা। তবে প্রজননের জন্য সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পারলে মাছের সম্প্রসারণ হয়। ধানের জমিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ তৈরি করে প্রজননের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। প্রজননের সময় মাছ যাতে বেরিয়ে না যায়, সেজন্য জমির আল প্রয়োজনমতো উঁচু করে নিতে হবে। ধানক্ষেতেও প্রজননের জন্য প্রতি দুই বর্গমিটারে তিনটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ মাছ মজুত করতে হবে।

হাপায় প্রজনন
হাপা বা ট্যাংকে নাইলোটিকা স্বাভাবিকভাবে প্রজনন ঘটিয়ে থাকে। সূক্ষ্ম ব্যাসের ৩ী৩ী২ মিটার পরিমাপের হাপা কোনো জলাশয়ে বাঁশের খুঁটিতে বেঁধে নাইলোটিকার প্রজনন করানো যায়। হাপায় প্রতি বর্গমিটারে একইভাবে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ৩:১ হারে মজুত করতে হবে। হাপায় প্রজনন ও পোনা উৎপাদন তুলনামূলক সহজ পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃত।
পাকা চৌবাচ্চায় প্রজনন
পাকা চৌবাচ্চায় তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি অনেকাংশ শিথিল থাকে বলে প্রজনন ও পোনা তৈরিতে চৌবাচ্চা হাপা পদ্ধতির মতো সুবিধাজনক। প্রজননের সময় চৌবাচ্চা এমন হওয়া উচিত, যাতে সহজে পানি দেওয়া ও বদলানো যায়। এতে ডিম ধারণকালে নাইলোটিকা স্বচ্ছন্দ থাকে। বিরক্তিবোধ প্রকাশের সুযোগ থাকে না। চৌবাচ্চার প্রতি জোড়া মাছের জন্য ১০ বর্গসেন্টিমিটার জায়গা করে দিতে হবে।
চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে প্রজনন
এ পদ্ধতির জন্য নাইলোটিকার ক্ষেত্রে কোনো হরমোন ইনজেকশনের প্রয়োজন হয় না। সতর্কতার সঙ্গে প্রজনন উপযোগী পরিপক্ব মাছ বাছাই করতে হবে। মাছে গাঢ় বর্ণ, খাড়া আঁশ, স্ফীত জননেন্দ্রীয় প্রভৃতি দৈহিক পরিবর্তন দেখে বোঝা যাবে প্রজনন উপযোগী হয়েছে কি না। এসব মাছ বাছাই করে পেটের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয়। একইভাবে শুক্র সংগ্রহ করে ডিমের সঙ্গে মেশাতে হবে। মিশ্রণটি দুই মিনিট পর্যন্ত ভালোভাবে নেড়ে ডিম নিষিক্ত করতে হবে। নিষিক্ত ডিমের সঙ্গে ১০ সিসি লবণ-পানি মিশিয়ে আবারও দুই থেকে তিন মিনিট নেড়ে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর এ ডিম পরিস্ফুটন হ্যাচারির পাত্রে রেখে দিতে হয়। এতে কৃত্রিম বায়ুপ্রবাহ সরবরাহ করা গেলে পরিস্ফুটনের হার সন্তোষজনক হয়। এ পদ্ধতিতে ডিমের পরিস্ফুটন হতে দুই থেকে তিন দিন লাগতে পারে। পরিস্ফুটনের পর রেণু পোনা স্থানান্তর করতে হয়।
প্রজননে যেসব শর্ত
নাইলোটিকা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারলেও কিছু ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থা সুষ্ঠু উৎপাদন ও প্রজননকে প্রভাবিত করে। তাই কয়েকটি শর্ত মেনে চললে প্রজননে তা সহায়ক হতে পারে।

তাপমাত্রা
নাইলোটিকার প্রজননে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা জরুরি। ২১ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে ভালো। অনেক গবেষকের মতে, এমন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় এ মাছ বছরব্যাপী প্রজনন ঘটাতে পারে।
লবণাক্ততা
নাইলোটিকা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ লবণাক্ততা ও বয়ঃসন্ধিক্ষণে পৌঁছেও প্রজনন ঘটাতে পারে। এক্ষেত্রে পোনার বাঁচার হার স্বাদুপানির তুলনায় কম হতে পারে। তাই স্বাদুপানিতে প্রজননের ব্যবস্থা করা ভালো।
পিএইচ
পিএইচের মান কম-বেশি হলে নাইলোটিকার প্রজননে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এর মান নির্দিষ্ট থাকলে, অর্থাৎ সাত দশমিক ছয় থেকে সাত দশমিক আটের মধ্যে থাকলে ডিম নিষিক্ত হয় না। কিন্তু কিছুটা অম্লধর্মী, অর্থাৎ কমে গেলে এ মাছের ৮০ ভাগ ডিম নিষিক্ত হয়।
আলো
আলো নাইলোটিকার পরিপক্বতা অর্জনের গতি বাড়িয়ে দেয়। যে পুকুরে আলোর প্রক্ষেপণ দীর্ঘ, সে পুকুরে নাইলোটিকার প্রজনন দ্রুত হয়। গবেষকরা অ্যাকুইরিয়ামের পানির উপরিভাগে ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে এটি নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য আলোর উৎস পানিতে প্রজনন সহায়ক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৩ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন। প্রজননকৃত মাছের গর্ভ সঞ্চারের ক্ষেত্রেও আলোর প্রভাব থাকে।
মজুত সংখ্যা
মাছ প্রজননের পরিবেশ যাতে নিরাপদ থাকে, তাই পুকুরে কম মাছ রাখা উত্তম। কম মাছ মজুত করা হলে প্রজননের সময় পর্যাপ্ত স্থান পায় তারা। প্রতি বর্গমিটারে তিনটি পরিপক্ব মাছ ও স্ত্রী-পুরুষ মাছের অনুপাত ৩:১ হারে থাকলে পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে বলে ধরা হয়।
সহজে উৎপাদনযোগ্য চাষ পদ্ধতি
মাঝারি আকারের মাছ নাইলোটিকা। চাষ পদ্ধতি, প্রজনন ও খাদ্যাভ্যাস অনুকূলে থাকায় এর চাষ কমে যায়নি। বরং দিন দিন বাড়ছে। ছোট-বড় পুকুর, ডোবা, খাল, চৌবাচ্চা বা সিস্টার্ন প্রভৃতি যে কোনো আকার ও আকৃতির জলাশয়ে নাইলোটিকা চাষ করা যায়। স্বল্প বা গভীর জলাশয়, নোংরা বা স্বল্প অক্সিজেনযুক্ত পানিতে চাষ করা যায় বলে একে কষ্টসহিষ্ণু মাছ বলা হয়। এছাড়া নাইলোটিকার একক চাষ লাভজনক ও ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ হওয়ায় চাষিরা এ মাছ চাষে আগ্রহী হচ্ছে। এর চাষ পদ্ধতি জেনে নিতে পারেন:
পুকুর পদ্ধতি
যে কোনো পুকুর বা জলাশয়েই চাষ করা হোক না কেন, চাষের উদ্দেশ্যে পোনা মজুতের আগে সেটি চাষ উপযোগী করে প্রস্তুত করতে হবে। প্রকুর প্রস্তুতির মধ্যে প্রথমে প্রয়োজন রাক্ষুসে ও আগাছা দূরীকরণ। এরপর চুন ও সার ছিটিয়ে দিতে হবে। সার দেওয়ার পর পানি যখন সবুজ ও বাদামি রং ধারণ করবে, তখন পুকুর চাষ উপযোগী হবে। এ সময় চাষোপযোগী পোনা পুকুরে ছাড়তে হবে।

পোনা মজুত
চাষকৃত পুকুরে পোনা অথবা পরিপক্ব মাছ উভয়ই মজুত করা যায়। তবে চাষ পদ্ধতির ওপর পোনা মজুতের সংখ্যা নির্ভর করে। একককালীন চাষের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার পর্যন্ত পোনা মজুত করা যায়। পুকুরে পোনা ছেড়ে প্রজননের আগেই বাজারজাতকরণের উপযোগী মাছ ধরাকে এককালীন চাষ বলা হয়। আর অব্যাহত চাষ, অর্থাৎ পোনা ছেড়ে পর্যায়ক্রমে মাছ ধরা হয়। এমন চাষের বেলায় হেক্টরপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার পর্যন্ত পোনা প্রাথমিকভাবে মজুত করে চাষ শুরু করা যেতে পারে।
খাদ্য
নাইলোটিকা মাছ ক্ষুদ্র প্রাকৃতিক খাদ্যকণা থেকে শুরু করে উদ্ভিদ ও প্রাণিজ যে কোনো খাদ্য খেতে পারে। এছাড়া বড় আকারের খাবার যেমন রুটি, মুড়ি, চিড়া বা কোনো ধরনের ভাসমান খাদ্য পুকুরে ছুড়ে দিলে তা ঠুকরে খায়। যে কোনো খাবারে এ মাছকে অভ্যস্ত করানো যায়। সব ধরনের খাবার খেলেও চালের কুঁড়ো বা গমের ভূষি নাইলোটিকার উৎকৃষ্ট সম্পূরক খাদ্য। এসব খাদ্য দেওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাদ্যকণা সৃষ্টির জন্য মাঝেমধ্যে রাসায়নিক ও জৈবসার দিতে হবে।
ব্যবস্থাপনা
সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর নাইলোটিকার অধিক উৎপাদন আশা করা যায়। ব্যবস্থাপনার মধ্যে পানির স্তর অক্ষুণœ রাখা, নিয়মিত খাদ্য ও সার দেওয়া, জলাশয় অনুযায়ী মজুতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রজননের পর প্রজননকৃত মাছ সরিয়ে ফেলা উচিত। স্ত্রী অথবা পুরুষ মাছের যে কোনো একটি চাষ করতে হবে। নাইলোটিকা চাষকৃত পুকুরে মাগুর, শিং প্রভৃতি মাছ চাষ করা লাভজনক। কারণ, এ-জাতীয় মাছ নাইলোটিকার অতিরিক্ত রেণু বা পোনা খেয়ে ফেলে। ফলে প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা যায় সহজে।
বিশেষ গুণের নেইকো শেষ…
নাইলোটিকা মাছ চাষের বিশেষ গুণ রয়েছে। তাই এর যথাযথ প্রচার ও প্রসার হলে সব বিদেশি মাছকে ছাড়িয়ে যাবে। এর বিশেষ গুণগুলো দেখে নেওয়া যাক

# নাইলোটিকার চাষকাল স্বল্পমেয়াদি। দুই থেকে তিন মাসের চাষ দিয়ে বাজারজাতকরণের উপযোগী মাছ আহরণ করা যায়
# স্বল্প কিংবা অধিক গভীরÑদুই পুকুরেই এ মাছের চাষ করা যায়। মৌসুমি পুকুর, ডোবা, খাল, ধানক্ষেত প্রভৃতি নাইলোটিকা চাষের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে
# স্বল্প অক্সিজেনযুক্ত পানি অথবা অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের পানিতে বেঁচে থাকতে পারে। তাই এমন প্রতিকূল পরিবেশেও চাষ করা যায়
# উপকূলীয় অঞ্চলের অল্প লবণাক্ত পানিতে নাইলোটিকা মাছ বেঁচে থাকতে পারে। তাই এমন পানিতেও চাষ করতে কোনো অসুবিধা হয় না
# এ জাতীয় মাছ সর্বভুক শ্রেণির। শেওলা, জলজ কীটপতঙ্গ ও এর ডিম, শূককীট, মশা ও এর ডিম প্রভৃতি খায় নাইলোটিকা। এতে পুকুর বা জলাশয়ের দূষণরোধ হয়। পাশাপাশি মশা নিধনে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে
# এ মাছ বদ্ধ জলাশয়ে ডিম ছাড়ে ও বাচ্চা ফোটায়। এদের প্রজনন দ্রুত সম্পন্ন হয় বলে দ্রুত চাষ সম্প্রসারণ করা যায়
# চালের কুঁড়া, গমের ভুসি, খৈল, রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট প্রভৃতি সহজলভ্য খাবারে অভ্যস্ত নাইলোটিকা। আলাদাভাবে এদের জন্য খাবার কেনার প্রয়োজন হয় না। এতে কম ব্যয়ে মাছ উৎপাদন করা যায়
# বাড়ির আঙ্গিনায় মিনি পুকুরে নাইলোটিকা চাষে কোনো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় না। এতে মাছ উৎপাদন করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব, পাশাপাশি বাজারজাতকরণও করা যায়।