আমানুর রহমান খোকন, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ৭৪টি আনন্দ স্কুলের অস্তিত্ব নেই। কোথাও বেড়া থাকলেও ঘরের ছাউনি নেই। কোথাও ঘরের ভেতর খড়ের স্তূপ। আবার কোথাও শুধুই ঝুলছে আনন্দ স্কুলের সাইনবোর্ড। অথচ খাতা-কলমে সব স্কুল সচল দেখানো হচ্ছে। সে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, উপকরণ, পোশাক, শিক্ষকের বেতন, ঘর ভাড়ার কোটি টাকা যাচ্ছে রস্ক প্রকল্পের ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর, পুল শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের পকেটে।
কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় চর দীপচরের হতদরিদ্র ও ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলমুখী করতে রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্প-২ এর আওতায় পাঁচ বছর মেয়াদে ২০১১ সালে নতুন করে কাজ শুরু হয়। নাগেশ্বরী উপজেলার প্রথম দফায় চালু হয় ৩৯৫টি আনন্দ স্কুল। প্রথম দফার স্কুলগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ২০১৪ সালে আবারও ৮৪টি আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে ১০টি স্কুল বন্ধ এবং খাতা-কলমে সচল দেখানো হচ্ছে ৭৪টি স্কুল। সচল স্কুলগুলোর মধ্যে কেদার ইউনিয়নে ১২টি, কচাকাটায় পাঁচটি, নারায়নপুরে ৯, নুন খাওয়ায় ১৫, বল্লভেরখাসে ১৬, বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ৭, কালিগঞ্জে তিন, রায়গঞ্জে একটি এবং বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে তিনটি রয়েছে। বাকি তিনটি স্কুল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এসব স্কুল পরিদর্শন ও সমন্বয়ের জন্য উপজেলায় একজন ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর রয়েছেন শুরু থেকে। গত বছরের শেষে সাতজন পুল শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা প্রতিদিন স্কুলগুলোর সরেজমিন পরির্দশন করবেন। অথচ সরেজমিনে কয়েকটি স্কুলের বাইরে সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেলেও ভেতরে স্কুলের কোনো চিহ্ন নেই। কোনো কোনো ঘর ব্যবহার হচ্ছে অন্য কাজে। শুরুতে বেশিরভাগ স্কুলে মেয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় শিক্ষক বিয়ে হয়ে অন্যত্র চলে গেছে।
সাহেবের খাস আনন্দ স্কুলের শিক্ষক নারজুমান আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তার বাবা আব্বাস উদ্দিন জানান, মেয়ের বদলে তিনি স্কুল চালান। অথচ কোনো শিক্ষার্থী নেই, নেই হাজিরা খাতাও। বছরের শুরুতে প্রতি শিক্ষার্থীর পোশাক তৈরিতে পাওয়ার কথা ৪০০ টাকা। প্রতি মাসে শিক্ষা উপকরণ বাবদ ১ম-৩য় শ্রেণি ২০০ এবং ৪র্থ-৫ম শ্রেণি ৩০০ টাকা। পরীক্ষা বাবদ ১০০ টাকা। প্রতি মাসে শিক্ষকের বেতন তিন হাজার এবং স্কুল ঘর ভাড়া ৪০০ টাকা। ঘর মেরামতের জন্য বরাদ্দ এক হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কিন্তু বাস্তবে গত পাঁচ বছরে কোনো কোনো শিক্ষার্থী দু’একশ টাকা পেলেও বেশিরভাগের কপালে জোটেনি এক টাকাও। পোশাক ও উপকরণ কিছুই পায়নি কেউ কেউ। হাজীপাড়া আনন্দ স্কুলের শিক্ষার্থী মাজেদা খাতুন মিনা জানায়, ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভে উঠেছি। ফাউভের বই এখনও পাইনি। ক্লাস টু-এ একবার পোশাক পেয়েছি। শুধুমাত্র একবার পেয়েছি ১০০ আর একবার পেয়েছি ২০০। একই কথা জানায়, পঞ্চম শ্রেণির আতাউর রহমান। চতুর্থ শ্রেণির সাহিদা জানায়, পোশাক একবারও পায়নি। কেদার ইউনিয়ন পুল শিক্ষক নুর মোহাম্মদ জানান, নিয়মিত স্কুল চলে। পরে জানান, বিষয়টি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করলে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ হতে পারে।
স্থানীয়রা জানান, শুরুতে এসব স্কুল টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগেও টাকা নেয় প্রশাসন। প্রথমদিকে সাইনবোর্ড টানানো হলেও ধীরে ধীরে সেগুলো হারিয়ে যায়। সরেজমিনে ১০টির বেশি স্কুলে গিয়ে স্কুলের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খাতা-কলমে ১৫-৩০ জন করে শিক্ষার্থী দেখানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
একটি নুরানী মাদরাসার শিক্ষক হাবিবুল্লাহ জানান, প্রায়ই পাশের আনন্দ স্কুলের শিক্ষকরা মাদরাসায় গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আসে। অফিসার যাওয়ার পর তাদের পাঠিয়ে দেয়। এতে মাদরাসার পড়ালেখার ক্ষতি হয়। শিবেরহাটের ইসমাইল হোসেন জানান, স্কুল খোলে না। টাকা আসলে দুই-চারজনকে টাকা দেয়। যাদের নাম আছে তারা গেলে বলে নাম কাটা পড়েছে। অভিভাবক গেলে ১০০ টাকা হাতে দিয়ে বলে এমনি দিলাম। চার বছরে তার ভাগিনা উপবৃত্তির টাকা পায়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
রস্ক প্রকল্পের উপজেলা ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর (টিসি) আল মামুন প্রথমে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরে তিনি জানান, কত জায়গায় কত দুর্নীতি হচ্ছে, এগুলো ছোট বিষয়। তার কাছে তেমন কোনো অভিযোগ নেই। তিনি নিজেই অভিযুক্ত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা কেউ বলতে পারবে না আমি টাকা নেই। আনন্দ স্কুলের নানা অভিযোগ রয়েছে স্বীকার করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর কুমার বিশ্বাস জানান, আনন্দ স্কুলে অভিযোগ ছিল। রক্স প্রকল্পের কর্মকর্তা, পুল শিক্ষকদের কড়াভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
নাগেশ্বরীতে অস্তিত্ব নেই ৭৪ আনন্দ স্কুলের
