নাটক, ওয়েব সিরিজ হোক নির্মল বিনোদনের

সাজ্জাদ হোসেন : করোনাভাইরাসজনিত রোগের (কভিড-১৯) সংক্রমণ থেকে নিরাপদে থাকতে মানুষ একপ্রকার ঘরবন্দি। প্রয়োজন ছাড়া কেউ আগের মতো বাড়ির বাইরে আড্ডায় সময় কাটাচ্ছে না। বিশেষ করে তরুণদের বর্তমানে বিনোদনের অন্যতম সঙ্গী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল ফোন কিংবা ল্যাপটপ। সেখানে কেউ কেউ বিভিন্ন গেম, অনলাইনে পড়াশোনা এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিওকলে আসর জমানোর চেষ্টা করছেন। সেই দিক থেকে নাটক, ওয়েব সিরিজ এবং সিনেমা দেখার আগ্রহীদের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সম্প্রতি বানানো বেশ কয়েকটি নাটক এবং ওয়েব সিরিজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। কলাকুশলীদের অশ্লীল দৃশ্যই বলে দিচ্ছে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতি ক্রমাগতভাবে বিপর্যয়ের দিকে ধাবমান।

মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে রহস্য উম্মোচন করা। সেটি হতে পারে দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি অথবা অভিনয় জগতে। জনপ্রিয় নির্মাতা শিহাব শাহীনের ‘আগস্ট ১৪’ ওয়েব সিরিজের থ্রিলারের শুরুতেই বলা হয়েছে, এটি ১৮-এর নিচের দর্শকদের জন্য নয়। এমন ঘোষণা টিনএজদের বিরত রাখতে পারবে না; কেননা নিষিদ্ধ জিনিসের ওপরে সবসময় আসক্তি বেশি।

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে সহস্রাধিক পর্নো সাইট বন্ধ করা হয়েছে। মূলত ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে নিরাপদ রাখতেই এ উদ্যোগ। সাধারণত পর্নো বলতে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী চিত্রকে বোঝায়। পর্নো হচ্ছে যৌন আকাক্সক্ষা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌন-সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাকে বোঝায়। পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেমন এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বই, সাময়িকী, পোস্ট কার্ড, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, অঙ্কন, পেইন্টিং, অ্যানিমেশন, সাউন্ড রেকর্ডিং, চলচ্চিত্র, ভিডিও এমনকি ভিডিও গেম। সে হিসেবে বর্তমান ওয়েব সিরিজগুলোয় শিল্পীদের অঙ্গভঙ্গি পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণকেই বলা যেতে পারে। এটি আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না।

অন্যদিকে, স্ক্রিপ্টকে পরিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে গল্পের মধ্যে কলাকুশীলবদের ধূমপান এবং নেশা জাতীয় পানীয় গ্রহণের দৃশ্য নতুন নয়। নিয়ম করা হয়েছে, অবশ্যই নির্মাতাকে‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ এমন ধরনের ট্যাগ লাগানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু এসব নিয়মের আজকাল তেমন তোয়াক্কা করছে না অনেকেই; অথচ প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে কবেই জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছিলেন। সেটি বাস্তবায়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা অ্যাকশনও ইতোমধ্যে দেখা গিয়েছে। যদিও সরাসরি মাদককে নিয়ে কোনো গল্প নেই, তবে প্রত্যেক জিনিসের যে একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে তা সবার জানা। তরুণ সমাজের অনেকেই সেসব কুশীলবদের অনুকরণ করছেন। তারা ভাবছেন এটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটা ট্রেন্ডের মতো।

একইভাবে অশালীন ভাষা ব্যবহারের চর্চাও বেশ পুরোনো। গল্পকে জমানোর চেষ্টায় কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। যেমন সুমন আনোয়ারের ‘সদর ঘাটের টাইগার’ সিরিজ। অধিকাংশ কথোপকথনে একাধিক অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্যাপারটা আমাদের দৈনন্দিন আচার-আচরণের সঙ্গে খুব সহজাতভাবে নতুন করে মিশে যাচ্ছে। সেসব শব্দগুলো আমরা রাস্তাঘাটে পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপে অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় উচ্চারণ করি।

কাজল আরেফিন অমির ধারাবাহিক নাটক ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ও একই দোষে দুষ্ট। ব্যাচেলর জীবন নিয়ে নাটকের গল্প। সংলাপে অপভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড ধ্বনি দিয়ে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু তা একটু খেয়াল করে শুনলে স্পষ্ট বোঝা যায়। এই পরিচালকের সম্প্রতি বানানো নাটক ‘ব্যাচেলর কোয়ারেন্টাইন’-এর একটি চরিত্রের পোশাক নিয়েও অনেক সমালোচনা সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে এক চরিত্রের পরিহিত টি-শার্টে বিভিন্ন অশ্লীল শব্দ মুদ্রিত।

কুরুচিপূর্ণ উপাদান শুধু সামাজিক অবক্ষয়ই নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমাদের সুর-স্বভাবে বাঙালির নিজস্ব রূপ ও বৈশিষ্ট্য যুক্ত। বিদেশি উপাদান নিয়ে গল্প চর্চা করতে থাকলে এর প্রভাব সুদূর ভবিষ্যতেও থেকে যাবে। এর কারণে আমরা একদিন ভুলে যেতে পারি, বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেও নানা সুখ-দুঃখের গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যার মধ্যেও দর্শকরা আনন্দ পেয়ে থাকেন। নাটক-ওয়েব সিরিজে অভিনয় করছেন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। নির্মাতারাও নামিদামি। তারা দর্শকদের অনেক সৃজনশীল নাটক-টেলিফিল্ম উপহার দিয়েছেন। আমাদের নাটকের ইতিহাস  সমৃদ্ধ। হুমায়ূন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল মামুন ও মামুনুর রশীদের মতো নামকরা নাট্যকার দিয়েছেন অসাধারণ সব কাহিনি।

ওয়েব সিরিজের সেসব কন্টেন্ট বানাতে বাজেট সাধারণত বেশি রাখা হয়। এ কারণে অভিনেতাদের কাজ করার আগ্রহ থাকে বেশি। প্রয়োজনে অন্যান্য শালীন গল্পেও বাজেট বাড়ানো যেতে পারে। সেই সঙ্গে সরকারকে নাটক অথবা ওয়েব সিরিজ তৈরিতে নীতিমালা আওতাভুক্ত করতে হবে। কেননা, চলচ্চিত্র নির্মাণে বিধিমালা থাকলেও ওই দুটি ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন নেই। দর্শকরা সবসময় অধীর অপেক্ষায় থাকে সৃজনশীল শিল্পগুণ সম্পর্কিত কিছু পেতে, কিন্তু এমন ধরনের বিষয়বস্তু তাদের কাছে হতাশার। একজন লেখক একটি কাহিনি উপস্থাপন করেন লেখায়। সেই লেখা থেকে নাটক তৈরি  করেন নির্মাতা। তাই স্ক্রিপ্ট লেখার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরিবর্তন আসুক নাটক, ওয়েব সিরিজের বিষয়বস্তু এবং সংলাপে। প্রতিটি গল্প হোক শিক্ষণীয়।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: sajjathossain75200@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০