শীত উপলক্ষে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শাওইল গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। এখন বাড়তি রোজগারের সময়। তাই এ গ্রামের সব বয়সি মানুষ গার্মেন্টের বাতিল সোয়েটার থেকে নাটাইয়ে সুতা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আর তাঁত কারিগরদের মাঝে ধুম পড়ে গেছে হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম চালিয়ে শীতের গরম পোশাক, চাদর, কম্বল আর মাফলার তৈরির কাজে। প্রক্রিয়াজাত করা এসব সুতা ও শীতের গরম পোশাক বিক্রি হবে শাওইল বাজারে।
জানা গেছে, শাওইল বাজারে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ফলে এ বাজারকে কেন্দ্র করে শাওইল গ্রামের মতো দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, দেলিঞ্জা, পুশিন্দাসহ আশপাশের প্রায় ৭৫ গ্রামের মানুষ সুতা সংগ্রহ আর বস্ত্র তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এর মধ্য দিয়েই জীবিকানির্বাহ করছেন তারা। এর মধ্যে শুধু নাটাই ঘুরিয়ে সুতা সংগ্রহ করেন ১০ হাজার পরিবারের সদস্যরা। আর প্রায় চার হাজার তাঁত পরিবার চাদর, কম্বল, মাফলার ও লুঙ্গি তৈরি করেন হ্যান্ডলুম ও পাওয়ার লুম চালিয়ে। বলে রাখা ভালো, এসব গ্রামের মানুষের বছরের কোনো সময়ই বেকার বসে থাকাতে হয় না। গোটা বছরই কেটে যায় কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। তবে শীতকালটা তাদের জন্য বাড়তি আয়ের সুযোগ নিয়ে আসে।
শাওইল ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের প্রায় সব বাড়ির সব বয়সি নারী-পুরুষ সুতা হাতে নাটাই ও হ্যান্ডলুম ধরে মনোযোগসহ কাজ করছেন। জানা গেছে, শুধু এ গ্রামেই প্রায় ছয় হাজার মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা তিন হাজারের কাছাকাছি। এক দিনে কেউ নাটাই ঘুরিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি সুতা সংগ্রহ করতে পারেন। সংসারের কাজের পাশাপাশি নারীরা সকাল ৮টা থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত চড়কা ঘোরানোয় ব্যস্ত থাকেন। আর বাড়ির কর্তারা বেরিয়ে যান আগের দিন সংগ্রহ করা সুতা হাটে মহাজনদের কাছে নেওয়ার জন্য। চুক্তি অনুযায়ী তারা প্রতি কেজি সুতার জন্য ২০ থেকে ৩০ টাকা পান। বাড়ি ফিরে তারাও চড়কা নিয়ে বসে যান।
শাওইলে তাঁতের কারিগর রয়েছেন সাত শতাধিক। তারা এসব সুতা থেকে তৈরি করেন চাদর, মাফলার, কম্বল, সোয়েটার প্রভৃতি। এজন্য দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টার মতো সময় দিতে হয় তাদের। তাদের অনেকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মহাজনদের কাজ করেন। তারা প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা আয় করেন। আবার অনেক করিগর নিজেরাই এসব পণ্য তৈরি করে বাজারে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। এতে উপার্জন হয় তুলনামূলকভাবে বেশি।
প্রতি রোববার ও বুধবার শাওইলের হাটের দিন। এ দু’দিন ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে। প্রক্রিয়াজাত করা এসব সুতা ও তৈরি বস্ত্রের জন্য রাজশাহী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা আসেন।
কথা হয় কারিগর আবদুল হামিদ শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ও স্ত্রী দিনে পাঁচ থেকে সাত কেজি সুতা সংগ্রহ করি। পরদিন তা মহাজনের কাছে বিক্রি করি ১৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। তারা ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। তিনি আরও বলেন, সকাল থেকেই সুতা সংগ্রহের কাজে নামতে হয়। কাজ চলে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত।
শাওইল বাজারের সুতা ও ঝুট ব্যবসায়ী ইউনূস আলী পলাশ বলেন, গার্মেন্টের বাতিল ঝুট কিনে গ্রামের মহিলা ও পুরুষদের দিই নাটাই করার জন্য। এরপর প্রসেস করার পর এটি বাজারে বিক্রির জন্য তোলা হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে সুতা কেনেন। বিভিন্ন গার্মেন্টেও এসব সুতা সরবরাহ করা হয়। এই সুতাগুলো প্রকারভেদে ৫০ টাকা কেজি থেকে শুরু করে ২০০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করা হয়।
১৯৯০ সালে শাওইল বাজারের কার্যক্রম শুরু হয়। বাজারকে কেন্দ্র করে আদমদীঘি উপজেলাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে এখানে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কারিগরদের। যেমন এর আগে এখানে কোনো ব্যাংক ছিল না। মুরইলয়ে গিয়ে লেনদেন করতে হতো। এখন ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং চালু হয়েছে। এখানে একটা ব্যাংকের শাখা প্রয়োজন। তাছাড়া খোলা আকাশের নিচে ব্যবসা করতে বেশি সমস্যা হয় বর্ষাকালে। হাটে প্রবেশের রাস্তা প্রশস্ত নয়। এ কারণে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা ট্রাক নিয়ে এসে বিপাকে পড়ে যান জ্যামের কারণে। কারণ প্রতি হাটের দিন চারপাশে ভিড় করে শত শত ট্রাক, বেবিট্যাক্সি, অটোরিকশা, ভ্যান প্রভৃতি। এসব সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছে।
পারভীন লুনা, বগুড়া