নাটোরের হুলহুলিয়ায় শত বছরে আসেনি পুলিশ

মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, সিংড়া (নাটোর): আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। শিক্ষার হার শতভাগ। নেই একজনও নিরক্ষর। বেশিরভাগ অধিবাসী উচ্চশিক্ষায় আলোকিত। নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। নেই ঝগড়া-বিবাদও। দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো আর সুখে আনন্দ ভাগাভাগি করাই তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

এমন এক আদর্শ গ্রাম নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া। প্রায় শত বছরে এ গ্রামে কখনও পুলিশ আসার প্রয়োজন হয়নি।

জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার ও সিংড়া থানা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা ও শান্ত এক গ্রাম হুলহুলিয়া। চলনবিল বেষ্টিত এ গ্রাম ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত। গ্রামের আয়তন প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। গ্রামে স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। জনসংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, ভোটার দুই হাজার ৬০০।

গ্রামে রয়েছে একটি মসজিদ, মন্দির, কওমি মাদরাসা, ডাকঘর, উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ বিদ্যালয়। উচ্চ বিদ্যালয়ে রয়েছে ছাত্র সংসদ।

১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। বন্যার পর গ্রামের অনেক কৃষক ধানবীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। এক দিন গ্রামের সব পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে নিয়ে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে, তারা বিনা শর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে একটি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪০ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত সেই পরিষদ আজ হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামে প্রতিষ্ঠিত।

জানা গেছে, হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে গ্রামের নিজস্ব ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ২৩ সদস্যের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। এছাড়া পাঁচজন উপদেষ্টা থাকেন কমিটিতে। দুই বছর পরপর গ্রামবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হয়। গ্রামের পুরুষ ভোটারদের ভোটে এ পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদ গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করে। গ্রামটিতে ২৫ বছর ধরে সর্বনি¤œ লেখাপড়া জানা মানুষটিকেও কমপক্ষে এসএসসি পাস করতে হবে। কারও লেখাপড়ার খরচ বহন করার সামর্থ্য না থাকলে পরিষদ থেকে তা বহন করা হয়।

১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এ প্যানেল আলোচনার মাধ্যমে তা মীমাংসা করে। বড় কোনো অপরাধ সংঘটিত না হলে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কারোরই। আর বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা আছে বলে তারা পরিষদের ওপর নির্ভর।

ব্রিটিশ আমল থেকে হুলহুলিয়া গ্রামে নিজস্ব ব্যবস্থা চালু আছে। এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো বিরোধ হয়নি। গ্রামের বিচারব্যবস্থায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামির কোনো ঘটনা নেই। ১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেকে ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

গ্রামের সন্তান চিকিৎসকরা নানা সময় বিনা খরচে গ্রামবাসীকে চিকিৎসাসেবা দিতে আসেন। ১৯৪৪ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এ ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ‘শিকড়’ ও ‘বটবৃক্ষ’ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী।

গ্রামের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতন। গ্রামে রয়েছেন প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, আইনবিদ ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিয়া, আইন মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমত উল্লাহ প্রমুখ। হানিফ উদ্দিন মিয়া ছিলেন দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। ১৯৬৪ সালে তার হাত ধরে দেশে প্রথম কম্পিউটার আসে।

২০১৬ সালে জেডটিইর আর্থিক সহযোগিতায় দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে একটি ‘হুলহুলিয়া ডিজিটাল হাব’ স্থাপন করা হয়েছে।

হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. আনিছুর রহমান বলেন, গ্রামের সবাই শতভাগ শিক্ষিত। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতন। আমাদের গ্রামে প্রায় ১০০ বছর ধরে আজ পর্যন্ত কোনো পুলিশ আসেনি এবং কোনো মামলা থানায় যায়নি।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ বলেন, আমাদের গ্রামে যদি কোনো ঝগড়াবিবাদ হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের গ্রামের নিজস্ব বিধিবিধান আছে, সেখানে মীমাংসা করে ফেলি। আমাদের থানা বা কোর্টে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। গ্রামের মানুষ খুবই শান্তিপ্রিয়।

চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা বলেন, এ গ্রামের মানুষ শতভাগ শিক্ষিত। তাদের কোনো বিচার করতে হয় না, যা বাংলাদেশে দুর্লভ।

সিংড়া থানার ওসি নূর-এ-আলম সিদ্দিকী জানান, এ গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্যান্য এলাকার চাইতে সন্তোষজনক।

সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এমএম সামিরুল ইসলাম বলেন, আমি শুনেছি, প্রায় শতবর্ষের ইতিহাসে হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমা নেই। নিজস্ব সংবিধানে পরিচালিত হয়। গ্রামেই বিচার সালিশ হয়। বাস্তবতার আলোকে এটি সত্যিই বিস্ময়কর এক গ্রাম। সারাদেশের হানাহানি, মারামারি, বিরোধের মধ্যে হুলহুলিয়া গ্রাম যেন এক

শান্তির ভূখণ্ড।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০