Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 2:18 pm

নানা অনিয়মে টাকার কুমির জুনাইদ পলক

শেয়ার বিজ ডেস্ক: জুনাইদ আহমেদ পলক। একজন প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) হয়েও দাপটের সঙ্গে তটস্থ রাখতেন প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের। নিজের চালচলনের মতোই খামখেয়ালিতে ভরা ছিল তার হাতে থাকা বিগত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আইসিটি মন্ত্রণালয়। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতোই মন্ত্রণালয়কে নিজের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন তিনি।

পদে পদে ঘুস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, লুটপাটের প্রকল্প তৈরি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে মালিক বনেছেন হাজার হাজার কোটি টাকার। সূত্র: জাগো নিউজ
অভিযোগ রয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। উন্নয়নের নামে একের এক প্রকল্প তৈরি করে বাজেট থেকে টাকা লোপাট করেছেন। গত কয়েক বছরে এই টাকার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ প্রায় সবটাই তিনি দেশের বাইরে পাচার করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে বিগত সরকারের সময়। কিন্তু এর ফল পায়নি দেশের মানুষ। টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি খাতে ২০১০ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের রয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। এত কিছুর পরও ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রকৃত সুযোগ-সুবিধা থেকে দেশের জনগণ ছিল বঞ্চিত। এ খাতের অনিয়মের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি করার সময় কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন পলক।

তার দুর্নীতির অন্যতম উৎস ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, এটুআই প্রকল্প, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, হাইকেট পার্ক, আইটি পার্ক প্রভৃতি। আইসিটি খাতে উন্নয়নের নামে এসব প্রকল্প ছিল পলকের জন্য সোনার ডিমপাড়া হাঁস। আইসিটি খাতে যেকোনো প্রকল্প নিলেই ১৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো তাকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বড় অঙ্কের টাকার অনিয়ম পায় মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) কার্যালয়। ছয় খাতে এই অনিয়মগুলো করা হয়। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের হিসাব-সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে এসব তথ্য। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ সারা দেশে ৯২টি হাই-টেক পার্ক, সফটওয়্যার পার্ক ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করছে। এর মধ্যে ১৮টি পার্কে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চলমান। নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বড় অনিয়ম হয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয় বাজেটে অন্তর্ভুক্ত না করে অতিরিক্ত অনুদান গ্রহণ করায়।

লুটপাটের অংশ হিসেবে কিছু প্রকল্প সমাপ্ত এবং কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়। এর মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ছিটমহলগুলোয় আইসিটি প্রশিক্ষণ, ভার্চুয়াল ডেক্সটপ কম্পিউটিং নেটওয়ার্ক ল্যাব স্থাপন, লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রশিক্ষণ, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প, ইলেকট্রনিক নথি ব্যবস্থাপনা, ফ্রিল্যান্সার টু এন্ট্রিপ্রেনিউর উন্নয়ন, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট প্রস্তুতিকরণ, ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি, জাতীয় পর্যায়ে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন দক্ষতা, বাড়ি বসে বড়লোক প্রশিক্ষণ, সাইবার নিরাপত্তা, ইনোভেশন ফর স্মার্ট গ্রিন বিল্ডিং, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-শপ কর্মসূচি, মোবাইল গেম উন্নয়ন, তৃণমূলের তথ্য জানালা কর্মসূচি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এর মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে শুধু মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পতে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ৩৩০ কোটি টাকা। এটুআইয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয় ৮৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর দীক্ষা-দক্ষতা উন্নয়নে অনলাইনে শিক্ষা প্রকল্পে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৭৫ কোটি টাকা।
আইসিটি খাতে লুটপাটের আরও শত শত প্রকল্প করেছিলেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন প্রকল্পে পাঁচ হাজার ৯২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা, প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পে ২৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি প্রতিষ্ঠাকরণে ৪৪২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণে ১৫৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, টেলিযোগাযোগ খাতে কানেক্টেড বাংলাদেশ প্রকল্পে ৫০৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, এনভায়রনমেন্টাল ও সোশ্যাল ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক (ইডিজিই) প্রকল্পে দুই হাজার ৫৪১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ও ভিডিও কনফারেন্সিং শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে ৪৯৫ কোটি লাখ টাকা।

সবচেয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে হাই-টেক পার্ক প্রকল্প থেকে। শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের ১১টি প্রকল্পে সংশোধিত মিলিয়ে ব্যয় দেখানো হয় এক হাজার ৩৭০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, আইটি/হাই-টেক পার্ক স্থাপনে এক হাজার ৮৪৬ কোটি লাখ টাকা, বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি প্রকল্পে ৪৩১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ইকো সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৫৩ কোটি ছয় লাখ টাকা, ভারত বাংলাদেশ ডিজিটাল সেবা প্রকল্পে ৭৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি প্রকল্পে এক হাজার ১১৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং শেখ রাসেল ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ৯৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রকল্পের মতোই নামধারী আরও শত শত প্রকল্প বানিয়ে লুটপাটের মচ্ছব চালিয়েছে পলক সিন্ডিকেট।

সিংড়ার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৬ সালের তৎকালীন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে শেখ হাসিনার বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন জুনাইদ আহমেদ পলক। পরবর্তী সময়ে মতিয়া চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম, ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নাটোর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য হন পলক। ২০১৪ সালে দশম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপর একাদশ ও দ্বাদশ সংসদেরও একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। প্রথমবার এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে করেছিলেন নির্বাচন। প্রতিমন্ত্রী হয়ে আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান তিনি। দেশে ‘প্রযুক্তি খাতের মাফিয়া’ বলা হতো জুনাইদ আহমেদ পলককে। তার সঙ্গে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তার স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা। তাদের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বাড়ি রয়েছে এ দম্পতির। তারা মাঝেমধ্যেই সেসব দেশে অবকাশ যাপনের জন্য যেতেন।