Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:11 pm

নানা উদ্যোগেও গতি আসছে না পুঁজিবাজারে

আতাউর রহমান: ধুঁকে ধুঁকে চলছে দেশের পুঁজিবাজার। প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। সূচক বাড়ছে ধীর গতিতে। প্রতিদিনই প্রায় দুইশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট দর থাকছে অপরিবর্তিত। বাকি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও ইউনিট বৃদ্ধি ও কমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজারের গতিশীলতা কোনোভাবে ফিরে না পওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট বাড়ছে বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বাজারে লেনদেন বৃদ্ধি ও গতি ফিরিয়ে আনতে সাম্প্রতিক সময়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবু লেনদেন ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। সূচক বাড়ছে নামমাত্র, গত এক মাসে ডিএসইর প্রধান সূচকের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মাত্র ১০ থেকে ২০ পয়েন্ট বৃদ্ধি ও কমার মধ্যেই রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার লেনদেন প্রায় ছয় মাস পর সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা ছাড়ালেও সূচক বেড়েছে মাত্র সাড়ে সাত পয়েন্ট। তবে এ লেনদেন কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে শঙ্কা।

ফ্লোর প্রাইসের কারণে বিনিয়োগকারীদের বেশ কিছু বিনিয়োগ আটকে রয়েছে। সেসব শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে পারছেন না তারা। সেই সঙ্গে অন্য কোনো শেয়ারেও বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এছাড়া যেসব শেয়ারে লেনদেন হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে ব্ল–-চিপ বা মৌলভিত্তি কোম্পানি তেমন নেই। স্বল্প সময়ে মুনাফা করতেই পরিশোধিত মূলধন কম বা দুর্বল মৌলের কোম্পানিতে লেনদেন হচ্ছে। তাই তারল্য সংকটের কারণে বাজারকে গতিশীলতার নানা উদ্যোগ সেভাবে কাজে আসবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত কয়েক মাসে পুঁজিবাজারের জন্য নেয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑনতুন আইন অনুসারে করপোরেট বন্ড ও ডিবেঞ্চার ব্যাংকের এক্সপোজারের বাইরে থাকবে। এসএমই মার্কেটে বিনিয়োগের যোগ্যতা অর্জনে বাজারে বিনিয়োগের সীমা কমিয়ে ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগ ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়েছে। পুঁজিবাজারে দেয়া ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বন্ডে বাজার মধ্যস্থতাকারীর বিনিয়োগের সীমা পূরণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তুলে দেয়া ১৬৮টি শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস পুনরায় বহাল রাখা রয়েছে এবং ‘এ’ ক্যাটেগরির শেয়ারে ৪০ পিই বেশি হলেও মার্জিন ঋণ পাওয়ার সুবিধা দেয়া হয়েছে।

এদিকে কয়েক মাসব্যাপী এ উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনো পরিবর্তন বা গতিশীলতা বাজারে লক্ষ্য করা যায়নি। কিছু নির্দিষ্ট শেয়ারে লেনদেন হয়েছে এবং বিনিয়োগ করে আবার স্বল্প সময়ে মুনাফা সংগ্রহের জন্য তা তুলে নেয়া হয়েছে। এতে গত কয়েক মাস ধরে লেনদেন ৪০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মধ্যেই রয়েছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়ে লক্ষ করা গেছে, যা কোম্পানিগুলোর সর্বশেষ প্রান্তিক প্রকাশ এবং যেসব কোম্পানি ভালো মুনাফা করার সম্ভাবনায় রয়েছে সেগুলোর শেয়ারে বিনিয়োগ করা। যাতে পরে সেসব শেয়ার থেকে স্বল্প সময়ে কিছু মুনাফা করা যায়। এজন্য ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারগুলোয় সেরকম লেনদেন লক্ষ্য করা যায়নি। দেখা গেছে বেশিরভাগ ভালো শেয়ার এখনও ফ্লোর প্রাইসে রয়েছে এবং লেনদেন হচ্ছে না।

অপরদিকে যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন কম এবং ব্যবসা বা মুনাফা ভালো না সেসব কোম্পানিতে লেনদেন ও শেয়াররদর বৃদ্ধি দেখা গেছে। পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ার ফলে সেসব কোম্পানির শেয়ারদর দ্র–ত বৃদ্ধি পায়। ফলে এ ধরনের শেয়ার প্রতিনিয়ত কারসাজি চলে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, গত ১০-১২ কার্যদিবসে সূচক ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। কিন্তু এতে ভালো কোম্পানির অবদান নেই বললে চলে। যেসব কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ কারসাজির শেয়ার। পরিশোধিত মূলধন কম হওয়ায় শেয়ার নিয়ে শুধু কারসাজি চলে। এতে সর্বশেষ প্রান্তিক প্রকাশের সময় হওয়ার কারণে সেগুলো নিয়ে এখন কারসাজি চলছে বলে জানান তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে থেকেই কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ চলছে। ফলে প্রান্তিক প্রকাশের কোম্পানি ভালো করলে তার শেয়ারদর হুহু করে বাড়তে থাকবে। তাই আগে থেকে বিনিয়োগ করে রাখা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের একটা অংশ লাভবান হলেও আরেকটা অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। কারণ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী জানেন না, কোন কোম্পানির অবস্থা কেমন। এছাড়া বাজারে প্রতিনিয়ত কারসাজি চক্রের নানা কারসাজি চলছে। কারসাজি করা শেয়ারের কোম্পানির নামে মিথ্যা তথ্য বা গুজব ছড়ানো হচ্ছে যাতে সবাই সে শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী। তাই বাজার ভালো হলেও এর ভেতরের পরিস্থিতি জানার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি বাড়াতে হবে। বাজার ভালোÑএ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা যাবে না। বাজারে কীভাবে ভালো হচ্ছে এবং কারা কারসাজি করে চলেছে প্রতিনিয়ত সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেই সঙ্গে কারসাজি বন্ধ করে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে কঠিন ব্যবস্থা। যাতে কোনো কারসাজি বা ক্ষণিকের জন্য নয়; বরং স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের মাধ্যমে বাজারে গতিশীলতা ফিরে আসে বলে জানান তারা।

সেই সঙ্গে এত উদ্যোগেও দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ভালো না হওয়ার আশঙ্কা করে তারা বলছেন, বর্তমানে বাজারে তারল্য সংকট রয়েছে। যারা ভালো বা মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলো ফ্লোর প্রাইসে থাকায় সেই বিনিয়োগ আটকে আছে। এ কারণে শেয়ার বিক্রি করে নতুন কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া অনেক শেয়ারের দাম অতিমূল্যায়িত হওয়ায় সেখানে নতুন করে কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে শেয়ারগুলো যখন সঠিক দামে পৌঁছাবে তখন বিনিয়োগ শুরু হবে। এর মধ্যে আটকে থাকা বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ তুলে পুনরায় বিনিয়োগ করতে পারবেন। কিন্তু বিনিয়োগ আটকে থাকলে আর শেয়ার সঠিক দামে না পৌঁছালেও এত উদ্যোগেও বাজারে গতি আসবে না বলে জানিয়েছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও অধ্যাপক আবু আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, সূচক ও লেনদেন বাড়লেও বাজার ভালো হয়নি এবং গতি ফেরেনি। ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ার ফ্লোর আটকে আছে, আর বন্ধ ও দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ছে, এমন বাজারকে ভালো বলা যাবে না। এখন যারা বিনিয়োগ করছেন তারা স্বল্প সময়ে মুনাফার জন্য করছেন। যে কারণে খারাপ কোম্পানির কারসাজির শেয়ার হলেও বিনিয়োগ করে স্বল্প সময়ে এ বাজারে মুনাফা করছেন কিছু বিনিয়োগকারী।

তিনি আরও বলেন, বাজারে তারল্য সংকট আছে এবং যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে ততদিন এমনই থাকবে। দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন ফ্লোর প্রাইস থাকা অবস্থায় দেখা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ যারা ফ্লোর প্রাইসে থাকা শেয়ারে বিনিয়োগ করে আটকে আছে, তারা অন্য শেয়ার বিনিয়োগ করতে পারছে না। তাছাড়া শেয়ারগুলো অতিমূল্যায়িত হওয়ায় কেউ কিনতেও চাচ্ছে না। শেয়ারগুলো যখন সঠিক দামে আসবে তখন বিনিয়োগ বাড়ার কারণে লেনদেন বাড়বে। আটকে থাকা বিনিয়োগকারীরা নতুন শেয়ারে বিনিয়োগ করবে। এই কেনাবেচা বাড়লেই বাজারে তরল্য ও গতি বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এক ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেয়ার বিজকে বলেন, বাজারে এখন কেউ বিনিয়োগ করে না। সবাই স্বল্প সময়ে মুনাফার আশায় লেনদেন করে। প্রতিদিন যে কয়টি শেয়ার লেনদেন হচ্ছে তার বেশিরভাগই পচা কোম্পানির। শেয়ার কিনছে, যখন বিক্রি করার সুযোগ হচ্ছে বেঁচে দিয়ে অন্য একটা কিনছে। এভাবে তো আর বাজার ভালো বা গতিশীল হবে না।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া বিনিয়োগ করবেই বা কোন শেয়ারে এবং তারল্য পাবেই বা কোথায় এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আমার নিজেরই বেশ কিছু টাকা ফ্লোর প্রাইসে থাকা শেয়ারে আটকে আছে। এখন সেই শেয়ার বিক্রিও করতে পারছি না, আর টাকা তুলে অন্য শেয়ারও কিনতে পারছি না। যেসব ভালো কোম্পানির শেয়ার ফ্লোরে আছে সেগুলোয় নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করবে না। কারণ সেই শেয়ারের দাম এখনও অনেক বেশি। বাজার হচ্ছে শেয়ার কেনা-বেচার জায়গা। এখানে কোম্পানির ভালো ও খারাপ করার সঙ্গে, শেয়ারের দাম বৃদ্ধি ও কমার সম্পর্ক। কিন্তু দীর্ঘদিন যদি একই শেয়ারে টাকা আটকে থাকে তাহলে বাজারে তারল্য বাড়বে না, আর গতিশীলও হবে না বলে জানান তিনি।