Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:30 pm

নানা খাতের সিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী!

আবদুল্লাহ আল মেহেদী : দেশের চলমান পরিস্থিতি প্রত্যাশিত নয়। ইস্যু অনেক। গণমাধ্যম বেশ ব্যস্ত। নিউজরুম গমগমে। শিফট চেঞ্জ, রোস্টার পরিবর্তন। ক্যামেরা ও বুম নিয়ে ব্যস্ত সংবাদকর্মীরা। দুপুরের খাবার বিকালে বা সন্ধ্যায় খেতে হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক  সরকার ইস্যু, নির্বাচন কমিশন, জামায়াতে ইসলামী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, হেফাজতে ইসলামী ও সমামনা দলের আন্দোলন। রিজার্ভ, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, কূটনীতিক সম্পর্কসহ আরও কিছু। সরকারের মাথাব্যথা জামায়াত নিয়ে! গত ২৮ অক্টোবর নানা বাধা উপেক্ষা করে মতিঝিলে সমাবেশ করেছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করায় ডিবির হারুনুর রশিদ তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন, সেই সংবাদ এসেছে পত্রিকায়। শাপলা চত্বরে অবস্থান করে দখলে নিয়ে তাদের শক্তি জানান দিয়েছে। পুলিশ জামায়াত-শিবির মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। যেকোনো বিনিময়ে সমাবেশ জামায়াত করবে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে? ভবিষ্যৎ কী? দেশের প্রধান দুই দলের অনড় অবস্থান ও রাজনৈতিক ইস্যুতে বাজার ও দ্রব্যমূল্য ইস্যু দমে গেছে। পত্রিকার পাতায় নিত্যদিন বাজারদর থাকলেও টেলিভিশনের পর্দায় কম দেখা যায়। এত ইস্যুর ভিড়ে এটি আনা হয় না সংবাদের বরাদ্দ সময়ের মধ্যে। টিভিতে সেকেন্ড হিসাব করা হয় আর পত্রিকায় কলাম ও শব্দে। যারা আজকে বাজার করবেন বা গতকাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে এসেছেন, তারা এক কেজি আলু কিনতে ৫০ টাকা দিয়েছেন। কেন এত দাম? উৎপাদন কম না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ? আলু কি আমাদের আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে? ১৫ টাকায় আলু কেনা গেছে গত বছরের প্রথম দিকে, এখন প্রায় চারগুণ দিয়ে কিনতে হচ্ছে! শীতকাল এসে গেছে প্রায়। শহরে শীতের দৃশ্য না দেখা গেলেও গ্রামে শীত পড়ে গেছে। আগাম শীতের সবজি বাজারে এসেছে। প্রথম দিকে একটু দাম থাকে, এটা স্বাভাবিক; কিন্তু দামের মাত্রা যখন নাগালের বাইরে হয়? চলতি বছরের মাঝামাঝিতে টমেটো ৮০ টাকা ছিল, সপ্তাহে ও মাসে পাঁচ-দশ টাকা ওঠানামা করেছে। এখন তা শতকের ঘরে! টমেটো কি আমদানি করতে হয়? ফুলকপি, বাঁধাকপি আর গাজর ১১০ থেকে ১২০ টাকা। যখন বাজারে যাই দেখি মানুষের হতাশার চিত্র। মানুষের মুখে বিরক্তির ছাপ। অভিশাপের বাক্য। গার্মেন্ট কর্মী সন্ধ্যায় বাসার ফেরার পথে দুই কেজি চাল নিয়ে যায়! ৩০ টাকার পেঁয়াজ কেনে! ডিজিটাল পাল্লা, তাই কেজিতে নয়, মাপে টাকার হিসাবে কেনে। আমি কি জরিপ করেছিÑপ্রশ্ন আসতে পারে। না, আমি নিজে দেখেছি। কথা বলেছি।

চা ছাড়া পুরুষ মানুষের জীবন চলে না। অফিসে কাজের ফাঁকে চা, দিনমজুররা কাজের ফাঁকে চা আর বিড়ি কিংবা বনরুটির সঙ্গে একটি কলা। আগে এক কাপ কনডেন্সড মিল্কের চা পাঁচ টাকায় পাওয়া যেত। এ বছর তা বেড়ে ১০ টাকায় ঠেকেছে। ১০ টাকার নিচে বনরুটি মেলে না। যেসব পণ্যের দাম কমেনি, তারা জনকল্যাণবান্ধব ব্যবসায়ী ভাবলে ভুল হবে। পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। পটেটো চিপস এখনও ১০ টাকায় আছে! পরিমাণ কমতে কমতে ১২ গ্রামে ঠেকেছে। ২০১২-১৩ সালেও পরিমাণ ছিল ৩০ গ্রাম, তখন সাত টাকা মূল্য ছিল। গুঁড়াদুধের মিনি প্যাক পাওয়া যেত বিভিন্ন কোম্পানির। ১৫  গ্রাম ১০ টাকা। অক্টোবরের মাঝামাঝিতে ১০ টাকায় আট গ্রাম পাওয়া যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় বাজারের চিত্র। মানুষের হাহাকার। আফসোস আর দীর্ঘশ্বাস। কবে শেষ হবে পরিস্থিতি? কবে আসবে আগের চিত্র? এই প্রশ্ন মনে মনে। বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী এখন শুধু রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। বিপক্ষ দলকে হুমকি-ধমকি দেন। সংবিধানের ফতোয়া শেখান। বিএনপিকে রাজনীতি শেখান। যখন ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা হলো তখন মন্ত্রী মালেয়েশিয়ায় আর সচিব চীনে। মন্ত্রী দেশে দ্রুত এলেন না, বরং ঘোষণা দিলেন, ‘আমি পদত্যাগ করলে যদি দুর্ঘটনা আর না ঘটে, তবে পদত্যাগ করতে রাজি।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি দলের নিয়ন্ত্রিত প্রচারকর্মী বা তাদের এজেন্টরা উন্নয়ন ও সাফল্যের খবর প্রচার করে। সেখানে দেখা যায়, ২০০৬ সালের সঙ্গে বর্তমানের উৎপাদনের তারতম্য পরিসংখ্যান করে। দামের পরিসংখ্যান কেন করে না, তা জানি না।  আবার প্রতিদিন মোবাইল ফোনে উন্নয়নের বার্তা আসে। এখানেও আছে ২০০১ সাল ও আজকের দিনের পরিসংখ্যান।

লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপদে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। সংসার খরচ কয়েকগুণ বাড়লেও আয় বাড়েনি এক টাকাও। ফলে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরাও। স্ত্রীর দেয়া ফর্দ অনুযায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ঘুরতে হচ্ছে এক দোকান থেকে আরেক দোকান। মাছ-মাংসের দোকানে গিয়ে আকাশচুম্বী দাম দেখে ফিরতে হচ্ছে শুধু সবজি নিয়ে। গরুর মাংস যেখানে মানুষ শুক্রবার তথা সাপ্তাহিক বন্ধের দিন খেত, সেখানে মাসেও কেনা হয় না। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে অনেকেই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন, এমন সংবাদও আসে পত্রিকায়।

‘পারছে না মধ্যবিত্ত’ এমন তথ্য জানতে চেয়ে গুগলে সার্চ দিতেই দেখি দুঃখের চিত্র। পত্রিকাগুলো শিরোনাম করেছে হারিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত। আর সরকার বলছে অন্যকিছু। গত মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছিলামÑকবে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ মাছ খেয়েছেন? কমেন্টে উত্তর আসেনি! কারণ কী? তাহলে কেউ খায়নি?  অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা মেইল গত বছরের ৪ নভেম্বর  একটি প্রতিবেদনের  তারিখ সংবাদের শিরোনাম করেছে ‘ব্যয় মেটাতে চিড়েচ্যাপ্টা মধ্যবিত্ত’। এ বছরের ৪ অক্টোবর ইত্তেফাক শিরোনাম করেছে ‘আগে নিম্নবিত্তরা কিনে খেতে পারত না, এখন মধ্যবিত্তরা পারছে না’। ‘বেকায়দায় মধ্যবিত্ত’ এমন শিরোনাম করেছে নয়া শতাব্দী। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ সময়ের আলো খবরের শিরোনাম করেছে ‘নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের টিকে থাকতে গ্রামে যাত্রা’। অথচ সরকার বলে থাকে আগে নুনভাত খেতে চেয়ে তুষ্ট থাকত মানুষ আর এখন মাংস খাওয়ার বাসনা করে! এতে প্রমাণিত হয় মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে।  

অত্যধিক ব্যয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ঢাকায় থাকার স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে। কর্মহীন, চাকরিতে বেতন না পাওয়া এবং বাড়িভাড়া পরিশোধের বিড়ম্বনাসহ নানা সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে অনেকেই গ্রামে চলে যাচ্ছে। শহরের মায়া বিষাদে পরিণত হয়েছে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে তিন বেলা ভাত তুলে দিতেই কষ্ট হয় অনেকের। গ্রামে থাকা বাবা-মায়ের হক আদায়ে ও দায়িত্ববোধ থেকে টাকা পাঠাতে হয়। অনেকে নিজের পকেট খরচ বাদ দিয়ে টাকা দিচ্ছে বাবা-মাকে। এমন সংবাদ পড়ে সেসব বিষয় উপলব্ধি করে খারাপ লাগে। আমার মতো সাধারণ মানুষের খারাপ লাগলেও অভিজাত শ্রেণির কিছু হয় না। তারা সুপার শপে মাস্টার কার্ডের ঘষায় টাকা পেমেন্ট করেন। আমার যদিও বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় না, বাবা নিজেই বিত্তশালী, কিন্তু কামালের বাবা, হিমেলের বাবা, কিংবা জামিলের বাবা? তারা অপেক্ষা করে।

বিআইডিএসের গত বছরের জরিপে বলা হয়েছে, কভিডকালে এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। সামনের দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সংকটের দায় কার? পৃথিবীর বাণিজ্যনীতি না অন্যকিছু? সরকার কেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? বাণিজ্যমন্ত্রী কেন এ নিয়ে স্পষ্ট কথা বলতে পারছেন না। তিনি বলেছেন, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়! সাধারণ মানুষের মুখে শোনা যায়Ñসিন্ডিকেট কি সরকারের চেয়ে শক্তিশালী!

মুক্ত লেখক

সাভার, ঢাকা