এনামুল হক ফজলে রাব্বী: যৌতুক অভিশাপ। এ যৌতুক প্রথা বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ নারীদের শত শত বছর ধরে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে। যৌতুক ভয়াবহ ব্যাধির মতো বাংলাদেশে মহামারি ধারণ করেছে। বিশেষ করে এর শিকার হচ্ছে নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। কোনো পরিবারে কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়া মানে যেন সেই পরিবারে অভিশাপ নেমে আসা। দেশ থেকে যৌতুক প্রথা দূর করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়ই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৪২ বছর আগে আইনটি প্রণীত হলেও এ আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায়নি। বরং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যৌতুক আদান-প্রদান হয়েছে দেদার। বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কনেপক্ষ যৌতুক দিয়েই গেছে। আর যৌতুক না দেয়ায় কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কত নারীর সংসার ভেঙেছে, আর কত নারী যে খুন হয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার জন্য কারও শাস্তি হয়েছে-এমনটা খুব কমই দেখা গেছে।
সম্প্রতি যৌতুকের বলি ও নারী নির্যাতনের চিত্র: বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরের সূত্র থেকে নেয়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে ২০১৮ সালে ১০২ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে ৬৭২৮টি যৌতুকের মামলা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ১০৮ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন। ২০১৫ সালে ১৮৭ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের দেশে ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার সিংহভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের সাম্প্রতিক রিপোর্টে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৩) দেখা যায়, ২০১৩ সালে মোট ২৬৫ জন নারী যৌতুকের বলি হয়েছে। এর মধ্যে ১০৯ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার, ৩ জন এসিডদগ্ধ, ৪ জন স্বামীর গৃহ থেকে বিতাড়িত, ১২৮ জন হত্যার শিকার ও ২১ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১২ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে যথাক্রমে মোট ৩৭ জন ও ২৪ জন যৌতুকের শিকার। ২০১২ সালের অক্টোবরে ৩৭ জনের মধ্যে ১৮ জন নির্যাতনের শিকার, ১৮ জন হত্যার শিকার ও ১ জন আত্মহত্যা করেছে। এছাড়া ২০০৯-১০ বছরে যৌতুকের ফলে ৩৫৮ জন মৃত ও ১৬৯ জন নির্যাতিত হয়েছে। এছাড়া আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালে ১৮৬ জন এবং ২০০৭ সালে ১৭২ জন যৌতুকের শিকার হয়েছে।
মানুষের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করে সবার সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক, গঠনশীল দৃষ্টিভঙ্গিই পারে যৌতুক প্রথা নির্মূল করতে। যৌতুক প্রথা রোধে বর্তমান তরুণ সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তরুণরাই পারে স্বশিক্ষিত ও বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। এছাড়া নারীসমাজের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। নারীকে পণ্যদব্য হিসেবে বিবেচনা না করে নিজেদের অর্ধাঙ্গী হিসেবে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে সমাজের প্রত্যেক পুরুষকে। পুরুষদের অর্থলোভ ত্যাগ করে নারীর গুণ ও গৌরবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যৌতুক দেয়া ও নেয়াকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে সবাইকে বিবেচনা করতে হবে।
যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আইন ও যথাযথ প্রয়োগ: বাংলাদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার বিভিন্ন আইন পাস করেছে। নারীদের উন্নয়নের জন্য সরকার নারী উন্নয়ন ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি’ ঘোষণা করেছে। নারী নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। যেমন: (১) যৌতুকবিরোধী আইন ১৯৮০, (২) নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ১৯৮৩, (৩) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯৮৪, (৪) মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ [সংশোধিত ১৯৮৫], (৫) পারিবারিক আদালত আইন ১৯৮৫, (৬) সন্ত্রাসবিরোধী আইন ১৯৯২, (৭) নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০। নারী নির্যাতনবিরোধী আইনে যৌতুকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এ বলা হয়েছে যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু হলে এর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে। যৌতুকের কারণে আহত করা হলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হবে। আহত করার চেষ্টা করা হলে অনধিক ১৪ বছরের এবং সর্বনি¤œ ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হবে এবং সব ক্ষেত্রে আর্থিক দণ্ডের বিধান করা হয়েছে। সমস্যা হলো আইন থাকলেও জনসাধারণের সচেতনতার অভাবে তার সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না, তাই যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থী, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম