Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 10:17 am

নারীর কর্মসংস্থানের নাম বিউটি পার্লার

চন্দ্রশিলা ছন্দা: বাংলাদেশের নারীদের বড় একটি কর্মের স্থানজুড়ে আছে বিউটি পার্লার। পার্লারের জনপ্রিয়তা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে এবং তা সীমিত আকারে হলেও ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে। জানা যায় আমাদের বাংলাদেশে পার্লারের প্রথম যাত্রা শুরু হয় ঢাকায় ১৯৬৩ সালে। আর এটা করেন এ দেশে আসা চীনা নাগরিক কার্মেল চ্যাং লিউ শেই। প্রথমে এর কোনো নাম না থাকলেও ১৯৬৫ সালে এটি মে ফেয়ার নামে আবার চালু হয়। তার পরপরই হংকং বিউটি পার্লারও ছিল ঢাকায়। আরও পরে লি বিউটি পার্লার চালু হয়। সে সময়ে অভিনেত্রী এবং অভিজাত পরিবারের নারীরাই রূপচর্চা সাজসজ্জার সেবা গ্রহণ করতেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে প্রথম বিউটি পার্লার চালু হয় লুসি নামে। বাঙালি হিসেবে প্রথম বিউটি পার্লার খোলেন জেরিনা আজগর লিভিং ডল নামে। সেটা স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকের কথা। প্রথমে তিনি পুরানা পল্টনের গাজী ভবনে একটি ঘরে দুটি চেয়ার নিয়ে শুরু করেন পার্লার যাত্রা। পরে ১৯৯৬ সালে তিনি পার্লারটি গুলশানে স্থানান্তর করেন। এরপর নব্বইয়ের দশকে এসে যুক্ত হয় নগর সংস্কৃতির নতুন ধারা বেড়ে যায় বিউটি পার্লারের সংখ্যা এবং  বেড়ে যায় সেবা নাওয়া।

আমাদের দেশের ইতিহাস এমন হলেও মেকআপের প্রথম যুগের রেকর্ডটি মিশরের প্রথম রাজবংশ থেকে আসা। সেই সময় মিসরের নারীরা কানের নিচে ঢেকে রেখে অন্ধকারে সবুজ রং প্রয়োগ করে এবং কলের সঙ্গে উপরের ঢাকনাটি ব্লক করে এবং এন্টিমনি (একটি ধাতব উপাদান) বা স্যট থেকে তৈরি করা হতো এবং বিশ্বাস করা হয় যে ইহুদিরা মিশরীয়দের কাছ থেকে মেকআপ ব্যবহার গ্রহণ করেছিল, যা হোক পোশাকের পাশাপাশি সাজসজ্জার বিষয়টি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এর ইতিহাসও ব্যাপক। এর মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে মানুষের ব্যক্তিত্ব, রুচি, ভালোলাগা, সৌন্দর্য। সর্বপরি মনের সঙ্গে সাজসজ্জার একটি অসম্ভব সম্পর্ক তৈরি হয়। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপনে যে তৃপ্তি এবং পরিপূর্ণতা, তা থেকে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা যায়। তবে অবশ্যই সেটা পরিমার্জিত হতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে এ সাজসজ্জার জনপ্রিয়তা দিনে দিনে বেড়েছে বই কমেনি একটুও। মেয়েদের পার্লারের পাশাপাশি চলে এসেছে জেন্টসদের পার্লার। সেখানেও ফেশিয়াল, মাসাজ প্রভৃতি হচ্ছে। মেকাপের জায়গায় এসেছে স্থায়ী ট্যাটু এবং সারা শরীররে নানা রকম পেইন্টিং। মাসাজে এসেছে অকুপেশনাল ট্রিটমেন্ট। সুতরাং সংসারে যে নারী রাতদিন খেটেই যাচ্ছে তার একটু আরামের জায়গা হতে পারে বিউটি পার্লার। হতে পারে একটু রিল্যাক্সের জায়গা। থাইল্যান্ড, সিংগাপুরে ফুট মাসাজ, বডি মাসাজ পার্লারেরই একটি অনুষঙ্গ। এবং তা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটা একটি ট্রিটমেন্টও বটে।

করোনাকালীন এ গৃহবন্দি অবস্থায় কেমন আছেন সেসব উদ্যোক্তারা? এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনার ভয়াবহতায় দেশের সৌন্দর্য সেবা খাত বা বিউটি ইন্ডাস্ট্রি চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সৌন্দর্য সেবা খাত থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে। এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী উদ্যোক্তা। আর এসব পার্লারে কাজ করছেন প্রায় ১০ লাখ কর্মী। কিন্তু করোনায় এ বিপুল-সংখ্যক কর্মীরা  পড়েছেন চরম বিপদে। বিপদে পড়েছেন মালিকরাও। যদিও তারা সাধ্যমতো সহায়তা করছেন কর্মীদের। কিন্তু তাদেরও নির্ভর করতে হয় পার্লারের আয়ের ওপরই। করোনাকালে সেই পথও বন্ধ প্রায়। তাদের হাতে কোনো কাজ নেই। আয়  রোজগার নেই। তাদের দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়।

করোনাকালীন পার্লার ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে অথবা এক বছর বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে এ দুর্দিনে পার্লার ব্যবসায়ীরা নিজেদের এবং কর্মীদেরও জীবন বাঁচবে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজ করে তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম নারীনীতি প্রবর্তন করেন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় নারীনীতি চালু করেন।

বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসার জন্য বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। ভিজিডি, ভিজিএফ, দুস্থ নারী ভাতা, মাতৃত্বকালীন এবং দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য ভাতা, তালাকপ্রাপ্ত ভাতা, অক্ষম মায়েদের ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, আমাব বাড়ি আমার খামার প্রকল্প, ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রভৃতি। তবে গ্রামের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সরকারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া হয় মাত্র পাঁচ শতাংশ সেবামূল্যের বিনিময়ে। নারী উদ্যোক্তারা ক্ষুদ্র উদ্যোগ তহবিলের ১০ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক খাতের ১০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি নারী তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন।

সরকারি খাতে পার্লার ব্যবসার নাম যুক্ত করা গেলে অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের মতো পার্লার ব্যবসায়ীরাও দেশের উন্নয়নে আরও জোরালো অবদান রাখতে সক্ষম হবেন। আমাদের দেশে নিবন্ধিত পার্লারের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখেরও বেশি। ছেলেদের সেলুন বা পার্লারের সংখা পাঁচ লাখ। তবে ধারণা করা হয়, এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। মেয়েদের পার্লারে কর্মী হিসেবে সাধারণত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে আসা মেয়েরাই চমৎকার কর্ম দক্ষতার কারণে বেশ বড় একটা জায়গা দখল করে আছেন। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যার ১৮ শতাংশ নারী কর্মজীবীরা পার্লারে কাজ করছেন। বাংলাদেশে পার্লারের সেবা এবং সৌন্দর্য পণ্যের বাজার বছরে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের। কিছু পার্লার বাদে পুরো দেশে প্রতিটি পার্লারে গড়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ জন করে গ্রাহক যান সেবা নিতে। বিভিন্ন উৎসবে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ে।

অর্থের বিনিময়ে হলেও পার্লারে নারীরা হাসিমুখে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তারা সৎ এবং পরিশ্রমী। পার্লার পেশাও এক রকম নার্সিং, যেখানে শারীরিক এবং মানসিক পরিচর্যা করা হয়। তাই কোনো অবস্থাতেই তাদের ভ‚মিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ছোট-বড় সব পার্লার ব্যবসায়ীর জন্যই এখন ভাবার সময় এসেছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে না রাখলে বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতিও হবে পরিবারসহ সারা দেশে।

সরকারের উদ্যোগে গৃহীত ব্যবস্থায় নারী উদ্যোক্তারা এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে বিশেষ সুবিধাযুক্ত ১০  শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে। পুনঃঅর্থায়নে তহবিলের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য। নারীরা ২৫ লাখ পর্যন্ত এসএমই ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন জামানতদার ছাড়াই, শুধু ব্যক্তিগত পরিচয়ে। পাশাপাশি সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো নারীদের সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বিশেষ সার্ভিস চালু করেছে। সুতরাং সম্মিলিত ভাবনায় সুন্দর একটি পথ উম্মোচিত হোক, বিউটি পার্লারের ব্যবসা শিল্প দাঁড়িয়ে থাকুক স্বমহিমায়। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখার পথ সুগম হোক এ শিল্পের।

পিআইডি নিবন্ধ