Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 9:43 pm

নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

রিয়াদ হোসেন: মোবাইলভিত্তিক অ্যাপ ‘ও বোন’ সেবা থেকে শুরু করে, ট্রেনচালক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ড্রিমলাইনার ‘আকাশবীণা’ উড়িয়ে হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিচ্ছেন নারী। রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবক্ষেত্রে নারীর সরব উপস্থিতি। তৃণমূল থেকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ শিখরে দৃঢ় অবস্থান করে নিয়েছে বাংলার নারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে এক দশকে নারী ক্ষমতায়নে বহির্বিশ্বে ঈর্ষণীয় অবস্থান বাংলাদেশের।

‘অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়ন স্পষ্ট। এ তিন ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের পর সরকার কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছে। নারীদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে কর্মসংস্থান তৈরি করা হয়েছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরিতে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। সরাসরি নির্বাচনেও অন্যান্য দেশের সংসদের চেয়ে বাংলাদেশে সংসদে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। বর্তমান সংসদে নারী সদস্য আছেন ৭২ জন। ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে আইন পরিবর্তন করে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ১২ হাজার নারী প্রতিনিধিত্ব করছেন, ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছেন ৫০০ জন। প্রথম নারী স্পিকারসহ জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদ সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ওসি, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চপদে ৬০০ নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে নয়জন নারী কর্মরত রয়েছেন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী তাদের দক্ষতা-যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে শক্ত অবস্থান করে নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষায় নারী এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। তারা অধিক হারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। কর্মজীবী নারীর জন্য আবাসন সুবিধার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এছাড়া গর্ভবতী মায়েদের জন্য ছয় মাসের বেতনসহ ছুটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং বিধবা নারীদের জন্য বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দরিদ্র নারীদের ভিজিডি কার্যক্রমের মাধ্যমে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। সরকার নারীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করায় তাদের ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করছে।

সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর একটি বড় অংশজুড়ে আছে নারীর সুরক্ষা। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে নারীর জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্তে দ্রুত তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নারী ক্ষমতায়িত হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত বৈশ্বিক লিঙ্গবিভাজন সূচক (গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স), ২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বে লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশের অবস্থান। এ সূচকে বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৮তম। প্রতিবেদন বলছে, এমনটা সম্ভব হয়েছে অর্থনৈতিক সুবিধা ও অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে নারীর অগ্রগতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ নারী কর্মজীবী। ভারতে এ হার মাত্র ২৯ শতাংশ। নারীর সাক্ষরতা এবং শিক্ষায়ও বাংলাদেশ এগিয়ে। নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখার জন্য ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘লাইফ টাইম কন্ট্রিবিউশন ফর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করে ‘ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান উইমেন’। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদানের জন্য ‘সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে ভূমিকার জন্য গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন বর্তমান প্রধান শেখ হাসিনা।

বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও বিনামূল্যে বই প্রদান, ছাত্রী উপবৃত্তি, স্কুলে দুপুরে পুষ্টিকর খাবার বিতরণ করায় নারী শিক্ষায় জোয়ার এসেছে। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই প্রদান করায় অভিভাবকদের নারী শিক্ষাবিমুখতা ঘুচেছে। শিক্ষিত নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত হচ্ছেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, নতুন কর্মসংস্থান নারীর মধ্যে ঘরের বাইরে কাজ করার আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে। জাতীয় নারীনীতি প্রণয়ন, নারী উদ্যোক্তাদের সুদমুক্ত ঋণ, কাজের সুযোগ সৃষ্টি করায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কোনো জামানত ছাড়াই সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এসএমই ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আবার নারী উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণও নিতে পারছেন। বর্তমানে ৩০ লাখের বেশি নারী শ্রমিক পোশাকশিল্পে কর্মরত। সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ব্যবসায় সমান সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে ২০১১ সালে জাতীয় নারীনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দুস্থ, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্য বর্তমান সরকারের বহুমুখী প্রকল্প চালু আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ ভাতা, মাতৃত্বকালীন ও গর্ভবতী মায়েদের ভাতা, অক্ষম মা ও তালাকপ্রাপ্তদের জন্য ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, একশত দিনের কর্মসূচি প্রভৃতি। প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে দেশব্যাপী কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতায় গর্ভধারণ থেকে প্রসবকালীন সব খরচ, এমনকি যাতায়াত খরচও এখন সরকার বহন করে। এতে মাতৃমৃত্যু হার অনেক কমেছে।

বর্তমান সরকারের সদিচ্ছায় তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে। আর্থিকভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ায় বাল্যবিয়ে রুখতে মায়েরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। একসময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নারীকে নিয়োগ দিলে অনেক সংসদ সদস্য আপত্তি জানাতেন। এখন আর নারী-পুরুষ নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী তার অবস্থান বিবেচনা করা হয়। ফরম পূরণে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে নারীর স্বীকৃতি অন্যতম অর্জন। সন্তান গর্ভধারণ করে তার পরিচয় পাওয়া একজন মায়ের অধিকার। মায়ের এ অধিকার অর্জিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার কারণে।

নারীর প্রতি সহিসংতা রোধে প্রণয়ন করা হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা দমন ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২। নারীর সুরক্ষা নিশ্চিতে প্রণয়ন করা হয়েছে মানব পাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১১। বাল্যবিয়ে নিরোধ করে কন্যাশিশুদের সমাজে অগ্রগামী করার জন্য বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশুদের নিরাপত্তায় শিশু আইন যুগোপযোগী করা হয়েছে। হিন্দু নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে এবং সাতটি বিভাগে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার চালু করা হয়েছে।

নারীর এ সরব অংশগ্রহণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নারী এগিয়ে আসছেন এ পেশায়। এর ইতিবাচক ও উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাংবাদিকতার মতো ঝুঁকিপূর্ণ, দায়িত্বশীল পেশায়ও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান আজ দৃশ্যমান। পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ছিঁড়ে বাংলার নারীরা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। নারীর এ অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পিআইডি নিবন্ধ