নারীর ক্ষমতায়ন: প্রসঙ্গ কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশ

আশরোফা ইমদাদ: কলিংবেল বেজেই চলেছে অনবরত। কে যেন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। রান্নাঘর থেকে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেন আনিলা চৌধুরি। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো নেভিব্লু ইউনিফর্মের অবয়বকে দেখে চোখে পানি চলে আসে আনিলার। ইউনিফর্মের গায়ে জ্বলজ্বল করছে মানহা আলীনা লেখা সোনালি রঙের ব্যাজটি। চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লেও ঠোঁটে আছে প্রশান্তির হাসি। নিজে পুলিশের পোশাক গায়ে জড়াতে না পারলেও তার মেয়ে পুলিশ বাহিনীর এক গর্বিত সদস্য হবে বলে আনিলা স্বপ্ন দেখেছেন এতদিন। আনিলার এত বছরের ইচ্ছা আজ পূর্ণ হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা মায়ের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তার মেয়ে মানহা আজ বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে এএসপি হিসেবে জয়েন করেছে।

‘বাংলাদেশ পুলিশ’ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পুলিশ বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। ১৯৭৪ সালে প্রথম আট নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে তারা কাজ করতেন সাদা পোশাকে। ১৯৭৪ সালে স্পেশাল ব্রাঞ্চে মোট ১৪ নারীকে নিয়ে নারী পুলিশের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। এর মধ্যে সাতজন ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর এবং সাতজন কনস্টেবল। ১৯৭৬ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশে নারী সদস্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অস্থায়ী ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশে আট নারী সাব-ইন্সপেক্টর ও ২০ কনস্টেবলের পদ সৃষ্টি করা হয়। এরপর আশির দশকে পুলিশ বাহিনীর অরগানোগ্রামে সংশ্লিষ্ট সব পদ স্থায়ীকরণের মাধ্যমে নারী পুলিশের অবস্থান শক্ত জায়গায় আসে। মাত্র ১৪ নারী সদস্যের নিয়োগের মধ্য দিয়ে যে পথ চলা শুরু হয়েছিল, সময়ের আবর্তে ২০২১ সালে তা ১৫ হাজার ১৬৩ জনে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নারী কর্মকর্তা আছেন ২৭৪ জন। তাদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি একজন, উপমহাপরিদর্শক পদে দুজন, অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক পদে চারজন, ৭২ জন পুলিশ সুপার, ১০৯ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ১২ জন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপার পদে ১০০ জন ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণরত পুলিশ সুপার আছেন ১৮ জন। এছাড়া ১০৪ ইন্সপেক্টর, ৫৮৬ এসআই, ২৯ সার্জেন্ট, ৮৯৯ এএসআই, ১০ নায়েক এবং ১০ হাজার ৮০ কনস্টেবল আছেন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণরত কনস্টেবল আছেন এক হাজার ১২৭ জন।

নারীদের পুলিশে যোগদান নিয়ে একসময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অনেকেই মনে করতেন, নারীরা নার্স, শিক্ষক, কিংবা ব্যাংকার হবেন। তারা কেন পুলিশ অফিসার হবেন? এ মানসিকতা এখন আর নেই। ১৯৮৪ সালে ক্যাডারে প্রথম নিয়োগ পেয়ে কাজে যোগদান করেন পাঁচ নারী পুলিশ অফিসার। এরপর প্রায় ১৪ বছর পুলিশ বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন পদে নারী পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ বন্ধ ছিল। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে আট নারী সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নারীদের প্রবেশাধিকার আবার উম্মুক্ত হয়। দ্রুত বাড়তে থাকে পুলিশে নারীদের উপস্থিতি; সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে নারী পুলিশের সুনাম আর সাফল্য, প্রসারিত হতে থাকে নারী পুলিশের কর্মক্ষেত্রের ব্যাপ্তিও।

নারীর এ অগ্রযাত্রার পথ সহজ ছিল না কখনোই। পুলিশে যোগ দেয়ার পর নারী পুলিশদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পোশাক। একটি মেয়ে বা বাড়ির বউ পুলিশের পোশাক পরে রাস্তায় ডিউটি করবে, এটি সহজভাবে মেনে নিতে সমাজ প্রস্তুত নয় এখনও, যদিও তা আগের তুলনায় অনেক বদলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের পোশাক পরে ডিউটি করার সময় নারী পুলিশ সদস্যদের নানা ধরনের অপমানজনক কথাবার্তা শুনতে হয়। মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের। নারী পুলিশ সদস্যদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে একশ্রেণির পুরুষ কর্মকর্তার অসংবেদনশীলতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করেছে। নারী পুলিশ সদস্যরা জানান, পুলিশে নারীদের জন্য কর্মপরিবেশ আগের চেয়ে উন্নত হলেও তা সন্তোষজনক নয় এখনও। বিশেষ করে কনস্টেবল, নায়েক, এএসআই, এসআইদের মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। নারীদের কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পুরুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং নারীর সংখ্যা কম হওয়া। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় নারী পুলিশ অফিসারদের প্রতি অন্যান্য অল্পসংখ্যক অফিসার ইতিবাচক থাকলেও অনেক সহকর্মীর মনোভাব হতাশাজনক। প্রতি পদক্ষেপেই নারী পুলিশ সদস্যকে প্রমাণ করতে হয় যে, তারা পুলিশে চাকরি করতে পারে। কারণ পুলিশের মোট জনবলের চেয়ে নারীর সংখ্যা মাত্র সাত ভাগ। তবুও তারা থেমে যাননি। পুলিশের নারী সদস্যরা মেধা, যোগ্যতা আর দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করছেন। কনস্টেবল থেকে অ্যাডিশনাল আইজিপি সব পদেই নারীদের সরব উপস্থিতি। ডিআইজি থেকে পুলিশ কনস্টেবল, প্রত্যেক জায়গাতেই নারীরা তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার পুলিশ বাহিনীতে নারীদের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে জাতিসংঘ মিশনেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাঠাচ্ছে নারীদের। বাংলাদেশের নারী পুলিশ এখন মিশন এরিয়ায় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন এবং নিজেদের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বর্তমানে ৭৯ নারী পুলিশ অফিসার শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন। ২০১০ সাল থেকে কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশন পরিচালনা করছে বাংলাদেশের নারী পুলিশ। সেখানে এ পর্যন্ত এক হাজার ৪০০ নারী পুলিশ সদস্য কাজ করেছেন।

বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা থেকে শুরু করে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় রাজপথে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করছেন নারী সদস্যরা। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শুরু করে পুলিশের সব ইউনিটেই বর্তমানে নারী পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। তারা তাদের মেধা, যোগ্যতা, সাহসিকতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছেন। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ, জলদস্যুদের দমন ও মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ভূমিকায় থেকে অভিযানে অংশ নিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মোকাবিলায়ও অবদান রাখছেন নারী পুলিশ সদস্যরা। তারা কাজ করছেন নারী নির্যাতন, পাচার ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, একতরফা তালাকের ক্ষেত্রে দেনমোহর ও খোরপোশ আদায়, যৌতুকসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে। দায়িত্ব পালনকালে এমনকি তারা বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের জীবনও। পুলিশের সর্বত্রই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন তারা।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল সেন্টারে পুলিশের ৮০ শতাংশ কর্মরত সদস্য নারী। কল টেকার হিসেবে এরই মধ্যে নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন এখানে পুলিশ সদস্যরা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশের থানাগুলোয় নারী ও শিশুডেস্ক চালু করা হয়েছে। এগুলো পরিচালনা করছে পুলিশের নারী সদস্যরা। এখানে প্রায় চার হাজার নারী পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। তবে এখানে আরও জনবল প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ৯টি ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার পরিচালনা করছে নারী পুলিশ সদস্যরা। নারী পুলিশ সদস্যের কাছে একজন নির্যাতিত নারী তার সমস্যার কথা পুরোপুরিভাবে খুলে বলতে পারেন, কিন্তু পুরুষ পুলিশ সদস্যের কাছে সেভাবে বলতে পারেন না। এমনকি একজন নারী অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতেও একজন নারী পুলিশ জরুরি।

নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দক্ষতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০০৮ সালে চালু করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন)’। বাংলাদেশ পুলিশে নারীদের সর্বোচ্চ অবদান নিশ্চিত করা, পুলিশের সব পদ ও ইউনিটে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো, নারী পুলিশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি, পুলিশে নারীদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, জেন্ডার সংবেদনশীল পুলিশ পরিসেবা দেয়া এবং সমাজে নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশলগত লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক তিন বছর (২০২১-২০২৩) মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যদের কর্মক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালের ৮ মার্চ ‘বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ অ্যাওয়ার্ড, ২০১৮’ প্রদান করা হয়েছে। ছয়টি ক্যাটেগরিতে মোট ২০ নারী পুলিশ সদস্য এই অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া ‘রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)’, ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’-এ ভূষিত হচ্ছেন অনেক নারী পুলিশ। ২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে নারী পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী পুলিশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ নারী পুলিশকে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

সব সমস্যা উপেক্ষা করে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা ও পারিবারিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠায় এগিয়েছে নারীরা। এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, সুযোগ, লড়াই করার মনোবল ও অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা, কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীদের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও পরিবারের সাপোর্ট প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী এবং স্পিকারও নারী। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম ও নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। অপরাধ দমন ও নিরাপত্তায় নারী পুলিশ সদস্যরা সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন এরই ধারাবাহিকতায়। চ্যালেঞ্জিং পেশা পুলিশে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছেন নারীরা; মিলেছে স্বীকৃতিও। পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধির বিষয়ে অবদান রেখে চলেছেন তারা। এখনও সর্বত্র শুধু নারী পুলিশের প্রশংসা। নারী চ্যালেঞ্জ নিতে পারবেÑএমন মানসিক অবস্থানে সমাজ পুরোপুরি এখনও আসেনি। আর এজন্য সমাজের সব স্তরে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অপেক্ষার সে প্রহর শেষ হোক আমাদের সবার।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০