নারীর প্রতি সহিংসতার শেষ কোথায়?

ফারহানা খানম: আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা ও ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সাফল্য উদযাপনের উদ্দেশ্যে পালিত হয় এই দিনটি। ইতিহাস এগিয়ে চলছে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এভাবে যতবার ইতিহাসের পট বদলেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। সভ্যতার গোড়াপত্তন ও ক্রমবিকাশে নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একজন নারী তার কর্মে ও সংসারে এগিয়ে যান কখনও মা, কখনও বোন, কখনও বন্ধু, কখনও স্ত্রী, আবার কখনও বা সহকর্মী রূপে। আজকের পৃথিবী বিনির্মাণে নারীই ছিলেন পুরুষের সহযোগী, অনুপ্রেরণার অসীম আধার হয়ে।

নারী শুধু পুরুষের নম্র সহচরী নয়, বর্তমানে নারীরা পুরুষের সঙ্গে বুদ্ধির খেলায় মেতেছেন। বিরাঙ্গনা বেশে যুদ্ধ করছেন শত্রুর সঙ্গে। সাহসিক অভিযানে পাল্লা দিয়েছেন পুরুষের সঙ্গে। রাজনীতিতে পুরুষের সহযাত্রিনী নারী। দেশের কাজে আত্মদানের গৌরবে গরবিনী। ধর্মে, সমাজ সংস্কারে তার ভূমিকা অনন্য। সাহিত্যে-বিজ্ঞানে বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি। নারী এখন সংগ্রামী জীবনের অংশীদার, জীবন যুদ্ধের অন্যতম শরিক। তাই নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারী দিবস গভীর তাৎপর্য বহন করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীদের ঐক্যবদ্ধতার একটি বড় উদাহরণ। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নারীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কারণে পরবর্তী সময়ে এ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি পায়। এর ফলে নারীরা ভোটাধিকার পান এবং তাদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্য দূর হয়। নারী দিবস নারীকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের অধিকার আদায়ের দাবি, তাদের অবদান এবং সারাবিশ্বে তাদের অবস্থানের কথা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রে নারী অতুলনীয় হলেও দিনশেষে তারাই হচ্ছেন সহিংসতার শিকার। অনেকেই প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে হয়তো এমন ভাবেন, বিশ্ব এগিয়ে চলছে আপন মহিমায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পৃথিবী এসেছে হাতের মুঠোয়। তবে সব কাজ ছেড়ে দিবসকেন্দ্রিক উদযাপনে শুধু সভা-সেমিনার বা লেখনী দিয়ে নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা সময়ের অপচয়। বাস্তবতা হলোÑহিলারি ক্লিনটন, জেসিন্ডা আরডেন, কমলা হ্যারিস, মালালা ইউসুফজাই কিংবা নাম না জানা আরও অসংখ্য নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন ঠিকই; তবে তারা কিন্তু পুরো সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। বরং তাদের সফলতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প দ্বারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে মাত্র। বাস্তবের মাটিতে সাধারণ নারীদের অবস্থা অবশ্যই ভয়াবহ। দেশকালভেদে নির্যাতনের পরিসংখ্যানে পার্থক্য পাওয়া যাবে হয়তো, তবে সহিংসতা মুক্ত কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। ধর্ম নৈতিকতার ব্যাখ্যাগুলো আমরা সর্বদা মানলেও এক্ষেত্রে এসে যেন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়াই। অনেক ক্ষেত্রে এসবের অপব্যাখ্য দিয়ে মিলতালে নারী নির্যাতন কিংবা শোষণকে বৈধতা জানাই শুধুই নিজ স্বার্থে নিচুভাবে নিজ দানবীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে।

আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে দিকে দিকে আজ নারী প্রগতির বাদ্য বেজে উঠেছে। নারীর সঠিক ক্ষমতায়ন সৃষ্টির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হলেও নারী নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে নারীরা আজও নির্যাতিত। দেশের উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছেন নারী। গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছেন লাখ লাখ নারী শ্রমিক, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি সেক্টর। এছাড়া প্রশাসন, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসা সেবা সবক্ষেত্রেই রয়েছে নারীদের উল্লেখযোগ্য অবদান। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আধিপত্যে নারী এখনও অসাম্যের সম্মুখীন। জাতীয় সম্পদে নারীর অসম অধিকার, পারিবারিক আইনে নারীর অসম অধিকার প্রতিনিয়ত নারীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এছাড়া ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ কতশত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বয়ে বেড়ান নারীরা; তা বলে শেষ করা যাবে না। এমন একটি দিন নেই যেদিন নারী নির্যাতনের মর্মান্তিক কোনো ঘটনা খবরের কাগজে ছাপা হয় না। শিক্ষার অগ্রগতির ফলে বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের হার কমেছে সত্য, তবে তা সংখ্যার বিবেচনায় খুব বেশি নয়। বাল্যবিবাহের মতো কমতে পারত ধর্ষণ নামে আরেক ব্যাধি। শিক্ষা, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ধর্ষণ কমাতে পারেনি উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। একসময় পড়ার বখাটে ছেলেদের দায়ী করা হতো এর জন্য। কিন্তু আজ এই বখাটের স্থান দখল করে নিয়েছে প্রায় সবাই। শিক্ষক, ইমাম, গির্জার ফাদার, আত্মীয়স্বজন এমনকি পিছিয়ে নেই অনেক ক্ষেত্রে বাবারাও। নির্যাতনই শুধু নয়, অনেকে হারাচ্ছে মহামূল্যবান জীবন। এমন অনেক নির্যাতনের গল্প হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যায়। নারী অধিকার রক্ষার বিভিন্ন আইন থাকলেও দেখা যায় না তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। ন্যায্য বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের চাষ। নারীর প্রতি এ সহিংসতার শেষ কোথায়?

আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের পেছনে সবচেয়ে বড় বাধা পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষায় নারীর আরও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই নারী-পুরুষের সমতা বিধান করবে বলে আমি মনে করি। নারী যেদিন বদ্ধ জাল ছিন্ন করে বের হবেন, নারীর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও সহিংসতার অবসান ঘটবে, কেবল সেদিনই নারী দিবস সার্থক হবে।

‘আমি নারী, পুরুষের মতো আমিও সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারি’এটাই হোক এবারের নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০