নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে চাই সামাজিক সচেতনতা

মো. রায়হান আলী: নারীর প্রতি সহিংসতার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আমরা কি একবারও চিন্তা করছি নারীরা পরিবার, সমাজ তথা সৃষ্টিকুলের অলঙ্কার স্বরূপ। নারী মাতৃত্বে জন্ম নেয়ায় কী করে এই নারীকেই অবমূল্যায়ন করি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, দিন দিন সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য বেড়েছে নারী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন প্রকারের সহিংসতা। বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় করোনাকালে ধর্ষণের পরই সবচেয়ে বেশি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা। করোনাকালে নারী ও শিশুর প্রতি যত ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে অঘোষিত লকডাউনের সময় বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এই বছরের প্রথম দুই মাসের বেসরকারি পরিসংখ্যানেও এমনটাই দেখা গেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে বাংলাদেশ নারী অধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারীরা এখনও প্রতিনিয়ত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নানা ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন এবং শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নিজেদের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে আসক বলছে, ২০২১ সালের প্রথম ১০ মাসে বাংলাদেশে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ১৯৭ জন নারী, পারিবারিক সহিংসতার ফলশ্রুতিতে আত্মহত্যা করেছে ১২৮ নারী। এছাড়া বিগত ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ১৭৮ জন নারী, এদের মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২২০ জন, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৪৩ জন ও ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটে ২৭৬টি এবং আত্মহত্যা করেছেন ৮ জন নারী। এই কয়েক মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১১৬ নারী, তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। যৌতুককে কেন্দ্র করে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০১ জন নারী। নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। এছাড়া অ্যাসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ২০ জন।

আসক আরও বলছে, সহিংসতার এমন চিত্রের বিপরীতে খুব কম সংখ্যক ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হচ্ছে, বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং ন্যায়বিচার পাওয়া গেছে। নারীর প্রতি সহিংসতার এমন চিত্রের মূল কারণ হলো বৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। দেশের নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও এই মানসিকতা বাংলাদেশের সমাজে এখনও ভয়ানক মাত্রায় রয়ে গেছে। এছাড়া বিদ্যমান আইন ও বিচারিক কাঠামো এখনও নারীবান্ধব নয় এবং নারীর জন্য সহজগম্য নয়। এসব কাঠামো নারী অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল না হওয়ায় নারীরা আইনের আশ্রয় নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা পায়, নিরুৎসাহিত হয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে এবং ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে আসক ১১টি দাবি তুলে ধরেছে।

এই দাবিগুলো হলো ১. ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। নির্যাতন-সংক্রান্ত সরকারি পরিষেবাগুলো সবার জন্য সমানভাবে সহজলভ্য করতে হবে। ২. বাংলাদেশে যে সেবাগুলো রয়েছে যেমনÑ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারসহ অন্যান্য ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এ সুবিধাগুলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং প্রতিটি এলাকায় যথাযথ কার্যকর পুলিশি সহায়তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া বিদ্যমান সেবাগুলো যথাযথভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ও ১৪৬(৩) ধারা বাতিল করতে হবে। কেননা, এই দুটি ধারা মানবাধিকার বিরুদ্ধ এবং এতে করে অভিযোগকারী পুনরায় হয়রানির শিকার হন। ৪. নির্যাতনের মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া আইনে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। ৫. ২০০৭ সালে আইন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত ‘ক্রাইম ভিকটিম কম্পেনসেশন অ্যাক্ট’ আইনে পরিণত করতে হবে। ৬. নারীর অধিকার সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। শিক্ষা কারিকুলামে সমমর্যাদা, সমানাধিকার, বৈষম্যহীতা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৭. আইন ও বিচারিক কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে জেন্ডার সংবেদনশীল করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৮. সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি বৈবাহিক জীবনে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকারের বিধান আইনে সংযুক্ত করতে হবে। ৯. ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের ১৮ দফা নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে মেনে চলা এবং এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১০. উচ্চ আদালতের ১৮ দফা নির্দেশনা ব্যাপকভাবে প্রচার করা এবং দায়িত্ব বাহকদের যথাযথভাবে জানানো ও সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। ১১. নারীর চলাচলের স্বাধীনতা এবং নারীর মতো প্রকাশের স্বাধীনতা (অনলাইন ও অফলাইন উভয় ক্ষেত্রে) নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে এদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অর্ধেকের বেশি সময় পার করছে। এখানে এখন নারী নির্যাতনের চিত্র, পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা সব পাল্টিয়ে ফেলতে হবে। সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা থাকলেও তা বাস্তবে কতটা পরিলক্ষিত হয় তা প্রশ্নই থেকে যায়। তবে এটা সুনিশ্চিত করে বলতে পারি স্বাধীনতা-পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে নারীদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগগুলো খুব একটা টনিকের মতো কাজ করছে। যার ফলে নারী নির্যাতন আইন, নারীর সুরক্ষা আইনসহ নানামুখী পদক্ষেপগুলো নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রাখছে। যেহেতু আমাদের দেশ উন্নয়নমুখী তাই শুধু পুরুষকেই কর্মমুখী করলে চলবে না, পাশাপাশি নারীদের কর্মে নিশ্চয়তা প্রদানে তাদের কর্মস্থল, স্বাধীন চলাচলসহ সার্বিক উন্নয়নে আরও আধুনিকায়ন দরকার। অনেক নারীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নানা প্রকার যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন হেনস্তার শিকার হয়। সহিংসতার কোন কোন ধরন আছে, যা ব্যক্তির দ্বারা ঘটে যথাÑধর্ষণ, গৃহ নির্যাতন, যৌন হয়রানি, প্রজননগত জোর-জবরদস্তি, কন্যা শিশুহত্যা, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত, প্রসবকালীন সহিংসতা, উচ্ছৃঙ্খলা জনতার দ্বারা সহিংসতা বা দাঙ্গা, রীতি বা আচারগত চর্চা যেমন সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা কিলিং, যৌতুক সহিংসতা বা পণ মৃত্যু, নারী খৎনা, অপহরণপূর্বক বিবাহ বা জোরপূর্বক বিবাহসহ নানা সহিংসতা। পোশাক আর ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে একঘরে করে রাখা যাবে না। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসে এদেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে শুধু সরকারকে পরামর্শ দিয়ে দ্বায় এড়িয়ে গেলে চলবে না। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে কার্য পরিধি বিস্তর করতে হবে। আমরা যদি নিজ নিজ দায়বদ্ধতা থেকে পারিবারিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয়ে মানসিকতার পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি তাহলে নারী সহিংসতা রেকর্ডহারে কমতে পারে। বদলাতে হবে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবর্তনে আনতে হবে নামে কিছু পুরুষতান্ত্রিক হীন মানসিকতা ও নোংরামি মানসিকতা নারীর প্রতি। সামাজিকভাবে নারী সহিংসতা রোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে, গড়তে হবে সংঘাতমুক্ত এক সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা

md007rayhan@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০