Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:09 am

নারী অধিকার নিয়ে সমাজ কতটা সচেতন

আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে ধরা হয় না। গ্রামীণ পর্যায় থেকে শুরু করে শহুরে জীবনেও নারী এক পরিত্যক্ত বস্তু। গ্রামীণ জীবনে পুরুষের সঙ্গে জমি কর্ষণ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত নারীর বিরাম নেই। পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজ তো আছেই। গ্রামীণ সমাজে প্রায়ই দেখা যায় পুরুষ মাঠ থেকে পরিশ্রম করে ঘরে ফিরে খাবার পেতে একটু দেরি হলে স্ত্রীর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করে। আর উপহারস্বরূপ তো বেত্রাঘাত আছেই। এটি তো গ্রামের দৃশ্য, তবে শহুরে নারীর কি স্বস্তিতে আছেন।

স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে ভাগ্যকে অনুসন্ধান করার জন্যই গ্রামীণ মানুষ শহরে আসে। গ্রামে নারীদের একটি বড় অংশ সমাজ ও লোকলজ্জার জন্য কর্মহীন থাকে। ফলে অর্থ উপার্জনে পুরুষরাই একমাত্র ভরসা। কাজেই সেখানে পুরুষ যেভাবে শাসন করে নারী ওই সমাজে সেভাবেই থাকে কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। কিন্তু সেই পুরুষই যখন বিভিন্ন কুকর্ম করে আর্থিক সংকটে পড়ে তখন সংসার সামলাতে হিমশিম খায় এবং নারীকে বাইরে বের করে দেয় অর্থ উপার্জনের জন্য। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের বঙ্গ ললনারাই স্বামীর দুঃখ সন্তানের দুঃখ দূর করার জন্য স্বেচ্ছায় কর্মক্ষেত্রে নামে। এভাবেই অধিকাংশ পরিবার শহরে এসে আশ্রয় নেই। যেখানে সবার মূল উদ্দেশ্য ভালোভাবে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা।

নারীর কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেশ নির্ভরতার জায়গা গার্মেন্টস কারখানা তথা পোশাক শিল্প। এ শিল্পে প্রায় ৮০ ভাগ নারী কাজ করে। গ্রামীণ নারীদের বৃহৎ একটা অংশ বর্তমানে এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা বেশ বৃহৎ পরিসরে। এত সব কিছুর পরেও নির্মম বাস্তব সত্য হলো যে নারীরা এখনও পুরুষের খাঁচায় গৃহপালিত পাখির মতো বন্দি। গার্মেন্টসে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করে আসার পরে আবার স্বামী-সন্তানদের জন্য রান্না করা, ঘর গোছানো, কাপড় ধোয়া সমস্ত কাজই নারীকে করতে হয়। এসব কর্মকাণ্ডে নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাহবা দিয়ে নারী বলেই লোক দেখানো সম্মান করে। কিন্তু যখন ওই নারী গার্মেন্ট থেকে পারিশ্রমিক পায় তখন ঘরের পুরুষটি জবরদস্তি করে হলেও নারীর অর্থ আত্মসাৎ করে এবং নিজেকে স্ত্রীর নিকট বীর রূপে আবির্ভূত হয়। এমনও দেখা যায়, কোনো গার্মেন্ট যদি মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমে স্যালারি দেয়, তবে ওই ঘরে পুরুষই মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেম পরিচালনার মহান দায়িত্ব বহন করে। এভাবেই ‘বীরপুরুষরূপী’ কাপুরুষরা নারীর ওপর কর্তৃত্ব করে।

নারীর অর্থের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে অনেক পুরুষের মাঝে কর্মহীনতার প্রয়াস দেখা যায়। ফলে পাড়া মহল্লার যাবতীয় অনৈতিক কাজে ধীরে ধীরে তারা প্রবেশ করতে শুরু করে এবং মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। আর তখনও রক্ষাকর্ত্রীর দায়ভার পড়ে স্ত্রীর ওপর। স্ত্রী সারাদিন পরিশ্রম করে স্বামীর নেশা পানির অর্থ দিতে হয়। কোনো কারণে তার ব্যাঘাত ঘটলে তো বেত্রাঘাত, চরণাঘাত, ঝাড়ুর আঘাত প্রাপ্ত হবে। বেচারি মায়াময়ী স্ত্রীজাতি সমাজ, সংসার, সন্তানদের প্রতি অগাধ মায়া স্থাপন করার ফলে না পারে আত্মহনন করতে, না পারে দূরে কোথাও চলে যেতে। সত্যিই এ জগৎ সংসার বড্ড মায়াময়।

কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান তুলে ধরতে ২০২০ সালে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাÑঅর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে।

তবু বিজয়ের ৫১ বছর পেরিয়েও এখনও নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি। অথচ পৃথিবীর শুরু থেকেই এই নারীরাই যেকোনো সংগ্রামে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে এবং এখনও করছে।

সর্বোপরি, এ সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে জয় লাভ করতে হলে সবার আগে নারীকে হতে হবে, সুশিক্ষিত, আত্মপ্রত্যয়ী এবং নিজের অধিকার আদায়ে সচেতন। বিজয়ের এই মাসে নারী জেগে উঠুক আপন উদ্যমে।

আলী আহসান

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়