নারী উদ্যোক্তারাই আগামী দিনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি

মনোজিৎ মজুমদার : বর্তমান ডিজিটাল যুগে নারীরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সফলতা অর্জন করছে। নারী শিক্ষা প্রসারের ফলে নারীদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক গ্রামীণ নারী ক্ষুদ্র একটি ব্যবসার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হয়ে উঠছে।

‘স্মার্ট বাংলাদেশ, স্মার্ট এসএমই’কে সামনে রেখে শেষ হয়েছে জাতীয় পণ্য মেলা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তোদের তৈরি পণ্য বিক্রয়ের বৃহতম প্ল্যাটফর্ম এসএমই মেলার শেষ দিন ছিল গত ২৫ মে ২০২৪। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এবারে ১৯ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত সাত দিনব্যাপী ১১তম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপণ্য মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসএমই মেলায় এবার অংশ নিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বেশি ৭৫টি, পাটজাত পণ্যের ৪২টি, হস্ত ও কারুশিল্পের ৩৮টি, চামড়াজাত পণ্যের ৩২টি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্যের ২৭টিসহ বিভিন্ন খাতের প্রায় ৩১৫টি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া ৩০টি ব্যাংক, ১৫টি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ক্লাবসহ আরও প্রায় ৫০টি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নেয়। এই মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো শতভাগ দেশীয় পণ্য এবং মোট উদ্যোক্তার ৬০ শতাংশই নারী।

মেলায় বিভিন্ন পণ্যের বাজারজাতকরণের ওপর প্রশিক্ষণ ও অংশগ্রহণকারী আগ্রহী নতুন উদ্যোক্তাদের নিবন্ধন, স্টল ডেকোরেশন, প্রচলিত ও বহুমুখী পণ্যের গুণাগুণ বিচারে শ্রেষ্ঠ স্টলকে পুরস্কার দেয়া হয়। হস্তশিল্পজাত পণ্যকে ২০২৪ সালের বর্ষপণ্য ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। হস্তশিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিকভাবে নারীদের স্বাবলম্বী করাই এ আয়োজনের লক্ষ্য।

আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ২৮তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ হবে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে উন্নতি হয়েছে তার মূলে রয়েছে ব্যক্তি খাত। সেই ব্যক্তি খাতে দুই দশক আগেও নারীর অবদান ছিল সামান্য। তবে সম্প্রতি নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে।

অর্থনীতির মূল খাতে বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ নব্বইয়ের দশকে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেক খানি বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ থেকে দেখা যায়, গত ১০ বছরে কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ হ্রাস পেলেও নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে লক্ষণীয়ভাবে; তা সত্ত্বেও জাতীয় আয়ে নারীর অবদান অতি নগণ্য। কারণ কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে যথাযথভাবে জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত না করা এবং নারীর গৃহস্থালির কাজকে অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে গণ্য না হওয়া।

আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশে কুটির শিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাঁশ ও বেত শিল্প, তাঁত বোনা, জাল বোনা, মাদুর বোনা, শীতলপাটি তৈরি, নকশিকাঁথা তৈরি, কাচ, মোম, শোলা, পাটজাত দ্রব্য দিয়ে শৌখিন ও নান্দনিক জিনিসপত্র তৈরি, ওয়্যালমেট, বাটিক, বুটিক, মৃৎশিল্প ইত্যাদি শিল্পে প্রায় এককভাবে নারীরা অবদান রেখে যাচ্ছেন। নব্বই দশকের পর ‘বুটিক’ শিল্পের মাধ্যমে যে নবজাগরণ ঘটেছে তাতে কুটিরশিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে বহুগুণ। সাম্প্রতিক ই-কমার্স বা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা নারী উদ্যোক্তাদের নতুনভাবে পথ দেখাচ্ছে। অনলাইনে এখন বস্ত্র, গহনা, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনসামগ্রী থেকে শুরু করে অনলাইনে লেখাপড়া এবং স্বাস্থ্যসেবাও যুক্ত হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি নারী উদ্যোক্তা তৈরির পথ সুগম করেছে। অনলাইন মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি। ঘরে বসেই নারীরা ব্যবসা করতে পারছেন।

দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও অর্থনীতিতে নারীর অবদান আশানুরূপ হয়নি। কারণ অনানুষ্ঠানিক খাতে তাদের অবদান বেশি। তবে তা দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষিত নারীরা চাকরির পেছনে না ছুটে অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। সরকার এ বিষয়ে প্রণোদনা জোগাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়া সহজ করতে জামানত ছাড়াই ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। ফলে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। বিবিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, সরকারের কোনো না কোনো মাধ্যমে নিবন্ধন রয়েছে এমন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিল ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন। আর নারী উদ্যোক্তা ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯ জন। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিল মাত্র ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। পুরুষের তুলনায় নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা যথেষ্ট কম হলেও গত দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে তিন গুণের বেশি।

সরকারের নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও একজন নারীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথ কিন্তু এখনও মসৃণ হয়নি। নারী উদ্যোক্তারা মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য, অনলাইন, গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্রাফটস খাতেই আগ্রহী। বৃহৎ পরিসরে নারীদের ব্যবসা পরিচালনা ও উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা এখনও রয়েছে; যা দূর করা প্রয়োজন। যেমনÑআমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত ঋণপত্র (এলসি), নগদ সুবিধা ও জিএসপি সনদ পেতে নারী উদ্যোক্তাদের সময় ও অর্থ ব্যয় কমানো, নারীদের সক্ষমতা তৈরি, প্রচ্ছন্ন ব্যয় (হিডেন চার্জ) বন্ধ করা, লিড টাইম কমানো, ব্যাংকিং অর্থায়ন পেতে নারী উদ্যোক্তাদের গ্যারান্টারের সংখ্যা কমানো, নারীদের জন্য সক্রিয় হেল্প ডেস্ক চালু, অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিতদের কাছ থেকে সহযোগিতামূলক আচরণ ইত্যাদি সমস্যা দূর করতে হবে।

নারী-পুরুষ উভয়ের সম্পৃক্ততা ব্যতীত একটি দেশের সুষম উন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকার নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলসে াতধারায় সম্পৃক্ত করতে নানাভাবে প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে বাজেট বরাদ্দ, ঋণ এবং প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। নারীদের তৈরি শতভাগ দেশি, বৈচিত্র্যময় এবং গুণগত মানসম্পন্ন বিভিন্ন পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নারী উদ্যেক্তাদের হাত ধরেই আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড আরও মজবুত হবে। 

মুক্ত লেখক

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০