Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:57 pm

নারী ও শিশুর নিরাপত্তা: সিলিন্ডার ও পাইপলাইনে গ্যাসের ব্যবহার

সাঈদা সুলতানা: বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এ সঙ্গে জ্বালানি হিসেবেও গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ রান্নার কাজে এখন গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে থাকেন, যা এলপিজি বা এলপি গ্যাস নামে পরিচিত। এটি মূলত দাহ্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ এবং জ্বালানি হিসেবে রান্নার কাজে, গাড়িতে ও ভবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়। ১৯১০ সালে আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৯১২ সালে এ গ্যাস বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। আগে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের ব্যবহার শুধু শহরকেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্রামগঞ্জসহ সারাদেশেই ব্যাপকহারে গ্যাস ব্যবহƒত হচ্ছে। ফলে অসতর্ক ব্যবহারের কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা, যা প্রায়ই অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

গ্যাস বা সিলিন্ডার গ্যাস পাইপলাইন বিস্ফোরণের প্রতি ক্ষেত্রেই বেশিরভাগ সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশু। কারণ বাসাবাড়ি?তে গ্যাস ও গ্যাসের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরাই এগিয়ে এবং শিশুদের অবস্থান নারীদের আশপাশেই থাকে বলে বেশিরভাগ দুর্ঘটনায় নারীদের পাশাপাশি শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে।

বিগত কয়েক বছরের তথ্যে গ্যাস সিলিন্ডার ও পাইপলাইন বিস্ফোরণের ভয়ংকর চিত্রে নারী ও শিশুর প্রাণহানির ব্যাপক সংখ্যা লক্ষণীয়। পত্রিকায? প্রকাশিত ভয়ংকর বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোতে এ চিত্র উঠে এসেছে। মিরপুরে গ্যাস পাইপলাইনে বিস্ফোরণ, নারী-শিশুসহ দগ্ধ ৭, সূত্র- কালের কণ্ঠ, ২৬ আগস্ট, ২০২১। মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে শিশুসহ নিহত ৭, সূত্র-ভোরের কাগজ জুন ২৭, ২০২১। গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মা-মেয়ের মৃত্যু, সূত্র-বাংলাদেশ জার্নাল, ১৯ জুন ২০২১। হাজারীবাগে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নারীর মৃত্যু, সূত্র-বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট ১৫ জুন ২০২১। লালমনিরহাটে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুর মৃত্যু, দগ্ধ মা-বাবা, সূত্র-যুগান্তর, ১ মে ২০২১। নারায়ণগঞ্জে গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরণ: শিশুর মৃত্যু, দগ্ধ ৩৭, সূত্র-সমকাল, ৪ সেপ্টেম্বর ২০। রূপনগরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুর মৃত্যু, সূত্র-প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর ২০১৯। 

এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায়, যেহেতু সিলিন্ডারের গ্যাস খুব বেশি চাপে তরল করে প্রবেশ করানো হয়, তাই এটির বিস্ফোরণও খুব মারাত্মক হয়, এক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হলে, শক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এ শক ওয়েভ শরীরের যে অংশে লাগে, সে অংশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক সময় প্রাণহানিও ঘটে এর ফলে।

তাছাড়া সিলিন্ডার যদি লিক হয়, সেক্ষেত্রে গ্যাস ভালভ হোসপাইপ কিংবা রেগুলেটর লিক হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। নিম্নমানের বা মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার গ্যাসের চাপ রক্ষা করতে না পেরে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। যদি আগুন বা তাপ সিলিন্ডারের সংস্পর্শে চলে আসে, সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। অসতর্কতা, গ্যাসের চুলার চাবি বন্ধ না করা বা চাবি লুজ থাকা ইত্যাদি যেসব কারণে গ্যাস নির্গত হয়ে জমাট বেঁধে থাকে, সেসব কারণ বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে সহজে এবং ভয়াবহভাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে গ্যাস লিকের সময় চুলা জ্বালাতে ম্যাচের কাঠি ধরানোর সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে। 

বিস্ফোরণ প্রতিরোধে প্রতিক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। অনুমোদিত বিক্রেতাদের থেকেই গ্যাস সিলিন্ডার কেনা উচিত। এ সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে সিলিন্ডারে কোম্পানির সিল রয়েছে কি না, সিলিন্ডারটির সেফটি ক্যাপটি সুরক্ষিতভাবে লাগানো রয়েছে কি না, ভূমির সমতলে সমান ও শুষ্ক জায়গায় সিলিন্ডারটি রাখা হয়েছে কি না, গ্যাস ভর্তি অবস্থায়? সিলিন্ডারটি টানাহেঁচড়া বা মাটিতে গড়ানো কোনোভাবেই ঠিক নয়। বিক্রেতা বা ডেলিভারিম্যানের কাছ থেকে সিলিন্ডারের যথাযথ ব্যবহারবিধি ও ম্যানুয়াল সম্পর্কে জেনে নেয়া উচিত। সর্বোপরি বিস্ফোরণ রোধে বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে গ্যাস সিলিন্ডারের যেসব নিরাপত্তা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা মেনে চলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে।

গ্যাস লিকের ঘটনার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে আতঙ্কিত না হয়ে  ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করা, অত্যন্ত জরুরি। গ্যাস লিক হয়ে?ছে বা হচ্ছে বোঝা গেলে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, লাইট, ধূপকাঠি, মোমবাতি ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়া ও নিভিয়ে ফেলা উচিত। সিলিন্ডার কানেকশন বন্ধ করে সেখানে সেফটি ক্যাপ লাগাতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। গ্যাস লিকের ফলে গ্যাসের গন্ধ পেলে ঘরের সব জানালা ও দরজা খুলে দিতে হবে, ফ্যানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। ঘটনার তীব্রতা দেখা দিলে দেরি না করে ফায়ার সার্ভিস ও পার্শ্ববর্তী থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। নতুবা ৯৯৯ জরুরি নম্বরটি ব্যবহার করে সাহায্য চাইতে হবে।

এসব মতামতের ভিত্তিতে এটিই স্পষ্ট হচ্ছে যে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়?, সঠিক পরিচর্যা, জনসচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে সিলিন্ডার গ্যাস, পাইপলাইনে গ্যাসের যথাযথ ব্যবহার দুর্ঘটনামুক্ত করে তা সবার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করা সম্ভব এবং তা আমাদের করতেই হবে। তবেই সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো কার্যকর ও বাস্তবে রূপ নেবে সঠিক ও যথাযথভাবে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে?র অধীনে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বাণিজ্যিক, আবাসিক ও শিল্প গ্রাহকদের মধ্যে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস সাপ্লাই দিয়ে থাকে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওয়ে?বসাইট তথ্য অনুযায়?ী) অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও অবৈধ পাইপলাইন অপসারণ কার্যক্রম-সংক্রান্ত তথ্যে যা জানা যায?, প্রতিবেদনের মাস: আগস্ট ২০২১ (১ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত)। ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি/গ্রাহক থেকে মোট উচ্ছেদ করেছে, আবাসিক বার্নার/সংযোগ-৪৫৩,১৫৮, দৈর্ঘ্য-৭৩৭.৩১ কিলেমিটার, বাণিজ্যিক বার্নার/সংযোগ-২০৫ ও শিল্প বার্নার/সংযোগ-৬। ৩১ আগস্টের পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত অবশিষ্ট বার্নার/সংযোগ-২৯,৫৯৬, দৈর্ঘ্য-১০২ কিলোমিটার।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও অবৈধ পাইপলাইন উচ্ছেদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়? এবং আমরা আশাবাদী এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের এ উদ্যোগের ফলে গ্রাহকদের বৈধ ও নিরাপদ গ্যাসলাইন সংযোগ প্রাপ্তি ও ব্যবহার সহজতর হবে।

একসময় এমন দিন ছিল, যে সময় অনেক মফস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জে প্রায় সবাই লাকড়ি?, গাছের পাতা, খড়? সংগ্রহ করে, গোবর শুকিয়ে রান্নার জন্য আগুনের উপকরণ তৈরি করত। পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরনের উপকরণের মাধ্যমেও রান্না করার আগুন তৈরি করা হতো আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের মাটির চুলার প্রচলন ছিল আগে আরও বেশি, রান্নার কাজে কেরোসিন চালিত চুলাও ব্যবহার করা হতো সে সময়। এ নিয়ে নারীদের মধ্যে একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করত, অনেক সময় আগুনের উপকরণ সংগ্রহের অভাবে এমনকি সময়মতো রান্না করাও সম্ভব হয়ে উঠত না।

বর্তমান সরকার কম খরচে জ্বালানি গ্যাস সরবরাহ করে সারাদেশে মফস্বল, গ্রাম-গঞ্জে সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবেশ তৈরি করেছে, যার ফলে নারীদের সময় অপচয় রোধ হয়েছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়েছে, স্বল্প সময়ে অনেক রান্নার আয়োজনে সুবিধা তৈরি হয়েছে। আগে লাকড়ি ব্যবহারের কারণে চুলায় আগুন তৈরির উপকরণ সংগ্রহে রাখার জন্য একটা নির্দিষ্ট শুষ্ক স্থানে এসব উপকরণ স্তূপ করে রাখা হতো। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের পর এটার প্রয়োজন এখন আর হচ্ছে না বললেই চলে। গ্যাস ব্যবহারের ফলে এখন একটা খোলামেলা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নারীরা এখন সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। মফস্বল ও গ্রাম-গঞ্জেও আধুনিকতার ছোঁয়া এখন লক্ষণীয়।

আগে আগুন তৈরিতে পর্যাপ্ত উপকরণ সংগ্রহের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের গাছ কেটে লাকড়ি সংগ্রহ করা হতো। এতে বৃক্ষনিধন করে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে পরিবেশের সে বিপর্যয় অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হয়েছে।

সর্বোপরি, কম খরচে রান্নায় সিলিন্ডার ব্যবহারের মতো সরকারের এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ নারীসহ সব সাধারণ জনগণের জন্য এক আশীর্বাদ। সতর্কতার সঙ্গে নিয়?ম মেনে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করলে মফস্বল-গ্রামসহ সারা বাংলার নারী-শিশুরা যেমন দুর্ঘটনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে, তেমনি নিরাপদ সমাজ বিনির্মাণে নারীর অবস্থানও আরও সুসংহত ও সমৃদ্ধ হবে। কাজেই সিলিন্ডার ও পাইপলাইনে গ্যাসের বিস্ফোরণ প্রতিরোধে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

পিআইডি নিবন্ধন