রিয়াদ হোসেন: একটা দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হবে। অথচ আজকের দিনে সমাজে এ শিশুরাই হচ্ছে নানাভাবে নিগৃহীত। সমাজের জন্য অন্য যেকোনো শ্রেণির মানুষের চেয়ে শিশুরাই যেন বেশি নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। আমাদের সমাজে মানুষরূপী একশ্রেণির নরপিশাচ রয়েছে, যারা বারবার ছোবল মারছে কেমলমতি শিশুদের ওপর, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা যেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কখনও কখনও তারা শিকার হয় হত্যাকাণ্ডেরও।
কন্যাশিশুরা অপরিচিতদের পাশাপাশি পরিচিতজনদের কাছ থেকেও হচ্ছে যৌন হয়রানির শিকার। সমাজের অবক্ষয় এমন পর্যায়ে গেছে যে, এসব নরপিশাচ আপন-পর হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত ভুলে গেছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকের কাছ থেকেই কন্যাশিশুরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা এখন যেন নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়গুলো গণমাধ্যমেও প্রকাশিতও হয় না, থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। আবার কখনও কখনও কঠিন বিষয়গুলো ফলাও করে প্রচারিত হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। অনেকেই আবার লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়গুলো চেপে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও অশিক্ষিত কিংবা অল্পশিক্ষিত সমাজের মানুষজন কন্যাশিশুদের যৌন হয়রানির বিষয়টি চেপে যায় পরিবারের মানসম্মানের ভয়ে। কিন্তু কেউ কেউ আবার ঠিকই এসব অন্যায়ের ন্যায়বিচার চায়, নির্যাতনের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে মাদারীপুর জেলায়। জেলার একটি থানায় এক নারী তার সাত বছরের কন্যাশিশুকে নিয়ে এসেছেন অভিযোগ জানাতে তারই দূরসম্পর্কের দেবরের বিরুদ্ধে। মাসখানেক আগে এই দেবর তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর একপর্যায়ে শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে মা জানতে পারেন পুরো বিষয়টি। ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে গত ২৮ মার্চ আর পরিবারটি থানায় অভিযোগ জানাতে আসে গত ২১ এপ্রিল। অভিযোগ জানানোর পরপরই পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এক দিন পর আসামি বিচারিক আদালতে জবানবন্দি দেয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৪৯১টি এবং শিশুধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৯২১টি। শিশুরা প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। এ ধরনের শিশু নিগৃহের ঘটনা পরিবার, বিদ্যালয়সহ সমাজের প্রায় সব জায়গায় ঘটছে অহরহ। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তিরোধ করা-সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং সরকারের পরিপত্র রয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এসব ক্ষেত্রে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা যাচ্ছে, যা প্রকারান্তরে শিশুর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন। ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজের তালিকা রয়েছে। সরকার ২০২৩ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সে মোতাবেক কর্মপরিকল্পনা নেই। তাই শিশুদের পক্ষে বলারও কেউ নেই। শিশুর জন্য আলাদা অধিদপ্তর অথবা আলাদা কমিশন করার ওপর জোর দেন তিনি, যাতে শিশুর বিষয়গুলো দেখার জন্য শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন এবং তার দায়বদ্ধতা থাকে।
এদিকে বাল্যবিয়েও শিশু নির্যাতনের আরেক নাম। শিশুবিয়ে বা বাল্যবিয়ে কেড়ে নেয় শিশুর শৈশব। ২০১৯ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৫২৮ জন। বাল্যবিয়ের জন্য মারা গেছে একজন এবং আহত হয়েছে ৫২৪ জন।
দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতিসহ জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জনে বড় বাধা বাল্যবিয়ে। তবে এ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি ও প্রচার-প্রচারণার ফলে বাল্যবিয়ে কমতে শুরু করলেও এখনও প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তা অব্যাহত আছে, যা প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। আশার কথা, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসন ও শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে এসেছে। সম্মিলিত এসব উদ্যোগের ফলেই সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। অসচেতন অনেক পরিবার এখনও তাদের কন্যাসন্তানদের বাল্যবিয়ে দিয়ে থাকেন। তাদের ধারণা, বিয়ে দিলে সংসারের খরচ কমে যাবে। এ অজুহাতে তারা অল্পবয়সে কিছু মেয়েকে বিয়ে দিয়ে তার ভবিষ্যৎ জীবন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে কিছু কাজীও দায়ী। তারা টাকার বিনিময়ে বয়স বাড়িয়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজ করে। আবার গ্রামের কিছু অভিভাবক আছে, যাদের জš§নিবন্ধন সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা তাদের সন্তানদের জš§নিবন্ধন করেনি। ফলে এসব ক্ষেত্রে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বলা যায়, শিশু নির্যাতনের আরেক নাম বাল্যবিয়ে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, সব ধরনের অপরাধের ব্যাপারেই পুলিশ সতর্ক থাকে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিষয়টি আলাদা। এ ব্যাপারে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ যতœবান হওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু তার পরও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও শিশুদের জন্য আলাদা অধিদপ্তর অথবা আলাদা কমিশন থাকা একান্ত প্রয়োজন, যাতে শিশুদের বিষয়গুলো দেখার জন্য শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন করবেন, যেখানে তার দায়বদ্ধতা থাকবে কঠোর নজরদারির আওতায়। কেননা আজকের শিশুই জাতির আগামী দিনের কর্ণধার। তাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সুস্থতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে।
পিআইডি নিবন্ধন