নারী পাচার কি বন্ধ হবে না?

সামিহা খাতুন: নারী ও শিশু পাচার হচ্ছে একধরনের সহিংসতা, যা মানবসভ্যতার প্রতি উপহাস এবং বর্বর যুগের প্রতিচ্ছবি। বর্তমান বিশ্বে নারী ও শিশু পাচার এক মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০০৪ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী সাধারণত যে কোনো ধরনের শোষণের উদ্দেশ্যে, জোর খাটিয়ে, মিথ্যা প্রলোভন কিংবা ছলছাতুরী করে, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে এবং চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে অথবা যাকে পাচার করতে চাওয়া হয়, তার ওপর কর্তৃত্ব রয়েছে, এমন ব্যক্তিকে আইনবহির্ভূত উপায়ে টাকা দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে লোক সংগ্রহ, স্থানান্তর, আশ্রয়দান ও অর্থের বিনিময়ে গ্রহণ প্রভৃতি যে কোনো কর্মকাণ্ডকে পাচার বলে গণ্য করা হয় এবং পাচারকারী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পতিতাবৃত্তি বা নীতিবহির্ভূত বেআইনি কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে বিদেশ থেকে আনেন, অথবা বিদেশে পাচার করেন বা পাঠান, অথবা বেচাকেনা করেন বা ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন, অথবা একই উদ্দেশ্যে নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন। উল্লিখিত কাজগুলোর যে কোনো একটির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি পাচারকারী হিসেবে অভিহিত হবেন।’

বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশু পাচার কমবেশি সব সময়ই ছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়ার পর সেই পাচারের মাত্রা আরও বেড়েছে। নারী ও শিশু পাচারের একক কোনো কারণ নেই। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, মূলত পাঁচটি কারণে নারী ও শিশু পাচার সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণগুলো হলো দারিদ্র্য, সীমান্ত অতিক্রমের সহজ প্রক্রিয়া, সমাজে মেয়েদের অবমূল্যায়ন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব এবং বাবা-মায়ের অসাবধানতা ও অসতর্কতা। এছাড়া মানব পাচারের পেছনে দারিদ্র্য, কাজের সুযোগের অভাব, স্বল্প শিক্ষা, ভঙ্গুর পরিবার, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অভিবাসন নীতিমালা প্রভৃতি বিষয়কে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করার পরও বেকারত্ব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর আমাদের শ্রমবাজারে যে ২২-২৩ লাখ তরুণ প্রবেশ করে, তার সামান্য অংশই কাজ পাচ্ছে। তাদের বেকারত্বের ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পাচারকারী চক্র নানা প্রলোভন দেখিয়ে বেকার তরুণ-তরুণীদের বিদেশে পাচার করছে। আমাদের জনসংখ্যার একাংশ এখনও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের কর্মসংস্থানের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা সহজ হয়।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের একটি গবেষণাপ্রতিবেনে বলা হয়, উচ্চ আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে থানাগুলোয় ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালে চার হাজার ৩৩১টি,  ২০১৭ সালে চার হাজার ৬৮৩টি, ২০১৮ সালে চার হাজার ৬৯৫টি, ২০১৯ সালে ছয় হাজার ৭৬৬টি ও ২০২০ সালে অক্টোবর পর্যন্ত ছয় হাজার ২২০টি মামলা দায়ের করা হয়। আর চলতি বছরের প্রথম আট মাসে দেশে অপহরণ ও পাচারের শিকার হয়েছে ১৪৪টি কন্যাশিশু। এরমধ্যে অপহরণ হয়েছে ৫৮টি কন্যাশিশু, অপরদিকে জাতীয় মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাচার হয়েছে চার কন্যাশিশু। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে পাচার হয় আরও তিন কন্যাশিশু। এছাড়া ২০২০ সালে দেশে মানব পাচারের যে ৩১২টি মামলার বিচার হয়, সেগুলোর ২৫৬টি ছিল নারী পাচার ও যৌন সহিংসতা-সংক্রান্ত।

একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে জানা যায়, নারী ও শিশু পাচারের বিনিময়ে পাচারকারীরা বিদেশ থেকে নানা ধরনের অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে। এছাড়া পাচারকারীরা শিশু ও নারীর দেহের চোখ, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চড়া দামে বিক্রি করে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে কত নারী পাচার হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ বা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছে নেই। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হয়েছে। বছরে দেশ থেকে ২০ হাজার নারী, কিশোরী ও শিশু ভারত, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। অপর এক হিসাব অনুযায়ী কয়েক বছরে ভারতে অথবা ভারত হয়ে অন্যান্য দেশে ৫০ হাজার নারী পাচার হয়েছে। অন্য একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার নারী ভারত, পাকিস্তান, ওমান ও সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চমূল্যে পতিতালয়ে বিক্রি হচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এ চিত্র আরও ভয়াবহ। তাদের চড়া দামে বিক্রি করা হয় উটের জকির মালিকদের কাছে। এছাড়া তাদের শরীরের রক্ত বিক্রি করা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ব্যবসা, মাথার খুলি ও কঙ্কাল রপ্তানিসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। দেশে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে কয়েক হাজার মামলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে এবং নানা জটিলতায় দৃষ্টান্তমূলক বিচার অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকেও পাচারকারীরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজের তথ্যানুসারে, পাচারকৃত নারী ধনী ব্যক্তিদের রক্ষিতা, অশ্লীল ছবি তৈরিতে ব্যবহার, বাসাবাড়ি ও কল-কারখানায় লাভজনক শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার, শিশুদের বিকলাঙ্গ করে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার, কিংবা নিঃসন্তান দম্পত্তির কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি এবং মাদক চোরাচালানসহ নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি টেকনাফ অঞ্চলের রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী ও শিশু এবং পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী নারীরা পাচার চক্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

পাচারকারীরা এ সভ্য-সমাজেরই একজন হিসেবে কৌশলে নিজেদের লুকিয়ে রাখে। তাই সরাসরি তাদের শনাক্ত করাও বেশ কঠিন। আর তাদের মূল হোতা সচরাচর তথাকথিত বিত্তশালী এবং সম্ভ্রান্ত হওয়ায় তাদের বেছে বের করাও অসম্ভব। তারা শক্তিশালী সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত।

বর্তমানে দেশে ২৫ থেকে ৩০টি বা তারও বেশি চক্র নারী পাচারে জড়িত। প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নারী পাচারকারীরা তৈরি করেছে এক ভয়াবহ নেটওয়ার্ক। তারা টিকটক, লাইকি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, ডিসকড, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির অ্যাপস ব্যবহার করে পাচারের জন্য নারীদের সংগ্রহ করছে এবং তাদেরও উচ্চাভিলাষী জীবনের লোভ দেখিয়ে অতি সহজেই পাচার করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পাচারের যে উদাহরণগুলো পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, বিমান ও স্থলপথে সীমান্ত অতিক্রমের মাধ্যমেই বেশি সংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হয়। ইউনিসেফ ও সার্কের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এদেশ থেকে কমপক্ষে ১০ লাখ নারী ও শিশুকে পাচার  করা হয়েছে।

আমাদের দেশের সংবিধানের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর ৫ ধারায় নারী পাচারের অপরাধের ক্ষেত্র বর্ণনা করা হয়েছে।

৫(১): যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি বা নীতিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে বিদেশ থেকে আনয়ন করেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন, অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা কোনো নারীকে ভাড়ায় বা অন্য কোনোভাবে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করেন, বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারীকে তার দখলে, জিম্মায় বা হেফাজতে রাখেন, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনাধিক ২০ বছর বা অন্যূন ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

৫(২): যদি কোনো নারীকে কোনো পতিতার নিকট বা পতিতালয়ের রক্ষণাবেক্ষণকারী বা ব্যবস্থাপকের নিকট বিক্রয়, ভাড়া বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে যে ব্যক্তি ওই নারীকে অনুরূপভাবে হস্তান্তর করেছেন তিনি, ভিন্নরূপ প্রমাণিত না হলে, ওই নারীকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা হস্তান্তর করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তিনি উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর ৬ ধারায় শিশু পাচারের অপরাধ এবং এর শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধের জন্য আমাদের সমাজের সবার মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অধিকন্তু নারী-শিশু পাচার ও বিক্রি প্রতিরোধে যেসব আইনকানুন হয়েছে, তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করাসহ সীমান্ত এলাকার লোকদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। সেইসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ার অনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নারী ও শিশু পাচার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য গণমাধ্যম নিতে পারে বড় ধরনের ভূমিকা। এছাড়া সরকারের ও প্রশাসনের উচিত নারী ও শিশু পাচারকারী চক্রগুলোকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা এবং তাদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক নারী সমিতি, শিশু সংগঠনসহ, সার্ক, নানা সংগঠন ও জাতিসংঘকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০