সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস: সাতক্ষীরার তালা উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা মীম (মূল নাম নয়), বয়স ১৫। দারিদ্র্যের কারণে মীমের বাবা-মা দুজনই যশোর সদর উপজেলায় ধানের চাতালে কাজ করে সংসার চালান। তারা চাতালেই বসবাস করেন। মীম যশোরের কেশবপুরে মামার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেখান থেকে ফিরে আসার পথে মীমের পূর্বপরিচিত সুমন তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভারতে পাচার করে দেয়। পাচারের শিকার মীমকে ভারতের পুরান দিল্লির একটি বাড়িতে রাখা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে মীমের বাবা যশোরের কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর মীমকে ভারত থেকে উদ্ধার করার জন্য ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন মিসিং চাইল্ড অ্যালার্ট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হয়। মীমের বাবা সাতক্ষীরার তালা থানায় সুমনসহ পাঁচজনকে আসামি করে একটি পাচারের মামলা করেন। আসামি সুমন মীমকে ভারতে বিক্রি করে দেশে ফিরলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। দেশে ফিরে আসে মীম। পরে তাকে মনোসামাজিক সেবা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়।
রুবি (ছদ্মনাম) নামের দরিদ্র পরিবারের একটি মেয়ে ভারতের এক পতিতালয়ে পাচার হয়। পতিতালয়ে দুঃসহ জীবন কাটানোর পর স্থানীয় একটি সংস্থার সহযোগিতায় সে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ফিরে এসে রুবি আর ফিরে পায় না তার আগের জীবন। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আদর-স্নেহ-মমতা থেকেও বঞ্চিত হয় সে। সমাজ তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করে না। রুবিকে দেখলেই একজন আরেকজনের সঙ্গে কানাঘুষা করে, আজেবাজে কথা বলে। জীবনের প্রতি ঘৃণা হয় রুবির। সে আবার পতিতালয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
ইদানীং পাচারকারীদের টার্গেট হচ্ছে মফস্বলের কলেজপড়–য়া উঠতি বয়সী মেয়েরা। অল্পবয়সী গৃহবধূও টার্গেটের মধ্যে আছে। দেশের অভ্যন্তরে নারী পাচারকারী দালালরা কোনো একটি মেয়েকে প্রথমে টার্গেট করে। এরপর ওই মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে বেশ টাকা খরচ করে তারা। মেয়েটি প্রেমের ফাঁদে পুরোপুরি পা দিলে তাকে বিয়ের কথা বলে বাড়ি থেকে বের করে নেয়। পরে মেয়েটিকে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দালালের হাতে তুলে দেয়। শিশু সংগ্রহের পদ্ধতি আরও বিস্ময়কর। চক্রের সদস্যরা দীর্ঘসময় ধরে এই কাজ করে অতি গোপনে ও সতর্কতার সঙ্গে। প্রথমে তারা শিশুটির বাবা-মায়ের সঙ্গে জমিয়ে তোলে ঘনিষ্ঠতা, বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ঘটনাও ঘটে। এরপর সময়-সুযোগ বুঝে বিদেশে শিশুকে পাঠিয়ে মোটা টাকা রোজগারের লোভ দেখানো হয়। শিশুটির অভিভাবকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে তাদেরও সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কোনোমতে একবার রাজি করাতে পারলেই শিকার চলে আসে হাতের মুঠোয়। আবার ছোট শিশুদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাবা-মায়ের অজান্তেই অনেক সময় চুরি করে নিয়ে যায়।
প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে মীম ও রুবির মতো অনেক নারী ও শিশু পাচারের শিকার হচ্ছে। দেশে নারী ও শিশু পাচার হওয়ার মূল কারণ দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সমাজে মেয়েদের অবমূল্যায়ন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব, বাবা-মায়ের অসাবধানতা ও অসতর্কতা প্রভৃতি। সীমান্ত এলাকা অতিক্রম করে এক পরিবারের সদস্যরা অন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বাসনা অনেক সময় নারী ও শিশু পাচারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। দেশের সীমান্ত এলাকার ১৮টি পথ ব্যবহার করে এসব নারী ও শিশুকে ভারতে পাচার করা হয়, যাদের অধিকাংশের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। পাচারের পর পাচারকৃতদের পতিতাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফি সিনেমায় ব্যবহার, ভিক্ষাবৃত্তি, শরীরের রক্ত বিক্রি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ব্যবসা, মাথার খুলি ও কঙ্কাল রফতানি করাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়।
বিশ্বজুড়েই রয়েছে পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৯৯ নারী ও ১১৩ শিশুকে পাচারকালে উদ্ধার করে এবং মামলা করে ৭৩টি। ইউনিসেফের তথ্যমতে, এদেশ থেকে প্রতি মাসে ৪০০ নারী ও শিশু পাকিস্তান, ভারত, বাহরাইন, কুয়েত ও আরব আমিরাতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারী ও শিশু পাচারের পরিসংখ্যান নিয়েও নানা রকমের রিপোর্ট রয়েছে। হিসাবের বাইরেও পাচার হয়ে যাওয়া নারী ও শিশু থেকে যায় বলে পরিসংখ্যান নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে।
বাংলাদেশে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কেন উন্নতি হচ্ছে না, সেটাই প্রশ্ন। আসলে দেশে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসার না থাকায় সামগ্রিক অপরাধ প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে এবং তার প্রভাব এক্ষেত্রেও রয়েছে।
নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে পরিবার থেকেই। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা বাবা-মায়ের। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার আগে পাত্র সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিতে হবে। বাবা-মায়ের শুধু এই একটি পদক্ষেপই পাচার প্রতিরোধে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। ছোট বাচ্চারা যেন অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে কথা না বলে এবং অপরিচিত ব্যক্তির দেওয়া কোনো খাবার না খায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। সন্তানকে নিজ এলাকার বাইরে বা বিদেশে কাজে পাঠানোর আগে কর্মস্থল সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নিতে হবে।
পাচারকৃত নারী ও শিশুরা উদ্ধার হয়ে ফিরে আসার পর তারা যেন সামাজিকভাবে নিগৃহীত না হয়, পরিবারের সদস্যরা সে বিষয়ে প্রথমেই ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। পাশাপাশি উদ্ধারকৃত নারী ও শিশুদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করতে পারে। উদ্ধারকৃত নারী ও শিশুদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং কয়েকটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা কাজ করছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ২০১৬ সালে বিদেশ থেকে উদ্ধার হওয়া ৬৫০ নারী ও শিশুর মধ্যে ১৬৫ জনকে পুনর্বাসন করেছে।
নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভূমিকা ব্যাপক। ঘাটমালিক, দালাল, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রামপুলিশÑসবাই পাচার প্রক্রিয়াকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে থাকে। তাই তাদেরকে পাচার প্রতিরোধে একতাবদ্ধ করতে ইউনিয়ন পরিষদ জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। পাচারকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার পাওয়া নারী ও শিশুর পুনর্বাসন একটি জটিল সমস্যা। আমাদের মতো দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় প্রেক্ষাপট থেকেই এটি কঠিন। ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা উদ্ধারকৃত নারী ও শিশুকে নিজ সমাজে পুনর্বাসনে ভিজিএফ, ভিজিডি, বিধবা ভাতা প্রভৃতি কার্ডের আওতায় এনে দারিদ্র্য বিমোচনে সাহায্য করতে পারেন।
নারী ও শিশু পাচার বর্বর যুগের নিকৃষ্ট কাজ। আধুনিক যুগেও এ রকম ঘটনা ঘটছে। এটা সত্যিই অমানবিক। নারী ও শিশু পাচার রোধে সবার আগে আমাদের প্রত্যেকেরই সচেতন হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে নারী শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। কারণ যারা পাচারের শিকার হচ্ছে, তারা বেশিরভাগই অশিক্ষিত। যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে নারী ও শিশু পাচার।
পিআইডি নিবন্ধ