নাঈমা আকতার: গত মাসের শেষের দিকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এ খবর জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বলেই ধারণা। টানা তিন দিন বায়ুদূষণের শীর্ষে ঢাকা। এটা নতুন ঘটনা নয়। ফেলে আসা বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই, ২০১৪ সাল থেকে বছরের অধিকাংশ দিনজুড়ে ঢাকায় বায়ুর মান ছিল বিপজ্জনক। ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণে ঢাকা শীর্ষে উঠে আসে।
ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণ কিন্তু একটি নয়। মোটরযানের ধোঁয়া, যথেচ্ছ নির্মাণকাজ এবং রাজধানীর আশপাশের ইটের ভাটাগুলোর কারণেই মূলত বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন ক্ষতিকর বস্তুকণার কারণেও ঢাকার বায়ু আরও বেশি দূষিত হয়ে পড়ছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় সাড়ে সাত বছর। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়েরই প্রজনন স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দূষিত বায়ুর কারণে বিভিন্ন বায়ুবাহিত রোগ, যেমনÑনিউমোনিয়া, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস প্রভৃতি হতে পারে। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ক্ষতিকর বস্তুকণা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসকে দুর্বল করে ফেলে, যা আমাদের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রতি বছর মারা যান প্রায় ৯১ হাজার ব্যক্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৩৭ লাখ অকাল মৃত্যু ঘটে ঘরের বাইরের দূষিত বায়ুর কারণে। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যান্ত্রিক যানবাহন থেকে সৃষ্ট দূষণ মৃত্যুর একটি বড় কারণ। অর্থাৎ, একজন মানুষ যখন দৈনন্দিন যাতায়াতের জন্য হাঁটেন বা সাইকেল চালান বা গণপরিবহন বা অন্য যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করেন তখন তিনি সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণে আক্রান্ত হন। ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক যানজটের কারণে নগরবাসী যে পরিমাণ সময় যাতায়াতের জন্য ব্যয় করেন তাতে তাদের ওপর বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয় বলাই বাহুল্য।
শুধু ঢাকা শহর নয়, সমগ্র বিশ্বই বায়ুদূষণের সমস্যায় জর্জরিত। যানবাহনজনিত বায়ুদূষণ হ্রাসে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ঢাকা একটি ছোট শহর এবং এখানে জনসংখ্যা অনেক বেশি। রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন এ শহরে ৩ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি ট্রিপ সংঘটিত হয়। ঢাকা শহরে ভূমির মিশ্র ব্যবহার থাকায় এখানে প্রায় প্রতিটি পরিষেবা ১০-১৫ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে পাওয়া যায়। স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যাতায়াতের পরিবেশ সৃষ্টিকে প্রাধান্য দিয়ে নগর পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে যান্ত্রিক যানবাহনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে বায়ুদূষণ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন সম্ভব। বায়ুদূষণ ফ্রান্সের জন্যও একটি বড় সমস্যা। ২০২১ এর আগস্টে বায়ুদূষণ হ্রাসে ব্যর্থ হওয়ায় ফ্রান্স সরকারকে ১০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা গুনতে হয়েছে। ফ্রান্সের লিওন শহর নগর পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে বায়ুদূষণ হ্রাসে উদ্যোগী হয়েছে। তারা মূল সড়কের সঙ্গে হাঁটা ও সাইকেলের নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করেছে, যাতে গাড়িনির্ভরতা কমে যায় এবং বায়ুদূষণ হ্রাস করা সম্ভব হয়।
একজন মানুষ যে যাতায়াত মাধ্যমই ব্যবহার করুক না কেন, তার যাত্রার শুরু এবং শেষ কিন্তু হয় হাঁটার মাধ্যমে। ঢাকা শহরে প্রায় ৬০ শতাংশ জনগণ কোনো না-কোনোভাবে হেঁটে যাতায়াত করেন। এ শহরে যদি পথচারীদের জন্য স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদে হেঁটে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কিন্তু মানুষ অন্য যাতায়াত মাধ্যম, বিশেষত যান্ত্রিক বাহনের দিকে ঝুঁকবেন না। বর্তমানে ঢাকা শহরে পথচারীর জন্য কোনো সুবিধা নেই বললেই চলে। শহরে যান্ত্রিক যানের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে। ভাঙাচোরা-সঙ্কুুচিত ফুটপাত, যেখানে প্রশস্ত ফুটপাত আছে তা চলে যাচ্ছে অবৈধ পার্কিং, দোকানের মালামাল বা নির্মাণসামগ্রীর দখলে। সমতলে রাস্তা পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই, বরং যান্ত্রিক বাহন যাতে নির্বিঘেœ যেতে পারে সেজন্য আছে দোতলা সমান পদচারী সেতু। তাতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। কিছু এলাকার ফুটপাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য টেকটাইল এবং হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য র্যাম্প দেয়া হলেও এখনও পেডেস্ট্রিয়ান নেটওয়ার্ক নিশ্চিত না হওয়ায় উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। তুরস্কের অন্যতম ব্যস্ত শহর ইস্তÍম্বুলে প্রায় ২৫০ রাস্ত সম্পূর্ণ পথচারীদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং ফলস্বরূপ শহরটিতে হিস্টোরিক পেনিনসুলাতে বায়ুর মান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উন্নত হয়েছে। ঢাকা শহরেও পথচারীদের জন্য সড়ক উম্মুক্ত করে দেয়া হলে বায়ুদূষণ হ্রাসে অবদান রাখা সম্ভব হবে।
যান্ত্রিক যানবাহনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হলে যে বায়ুদূষণ হ্রাস সম্ভব, তা কিন্তু কভিডকালীন লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি। ২০২০ সালের মার্চে যখন লকডাউন ঘোষণা হয়, তখন যানবাহন চলাচল, কারখানা সব বন্ধ ছিল এবং ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ কমে গিয়েছিল বহুলাংশে।
যান্ত্রিক যান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বায়ুদূষণ হ্রাসে আরও কিছু উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ইটের ভাটা ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। ঢাকার আশপাশে ইটের ভাটা নিয়ন্ত্রণ করা এবং ইটের পরিবর্তে সিমেন্ট বালুর ব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধি করা যেতে পারে। তাছাড়াও শহরে বছরজুড়ে গ্যাস, টেলিফোন, পানি প্রভৃতির জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলতেই থাকে। এর ফলে জনদুর্ভোগ যেমন লেগেই থাকে, অতিরিক্ত ধুলাবালির কারণে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেশি থাকে। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন বা সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। নির্মাণকাজ ঢাকা শহরের নিত্যসঙ্গী। দীর্ঘদিন ধরে উš§ুক্তভাবে নির্মাণকাজ চলতে থাকে যা বায়ুদূষণ বৃদ্ধি করে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। একটি বেষ্টনীর মধ্যে নির্মাণকাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাধ্য থাকে সে বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং প্রয়োজন। শহরে পর্যাপ্ত সবুজায়ন করা হলে তা দূষিত বায়ু শোধন এবং নগরের তাপমাত্রা হ্রাসে সহায়তা করে। কাজেই নগরের সবুজ পরিসর বৃদ্ধিতেও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। ট্রান্স-বাউন্ডারি বা ক্রস বর্ডার বায়ুদূষণ হ্রাসের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারদের সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর বায়ুদূষণ হ্রাসে সফলতা আসবে।
নিঃশ্বাস না নিলে কোনো প্রাণীই বাঁচবে না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমরা দূষিত বায়ু গ্রহণ করছি। মৃত্যু তো অনিবার্য। কিন্তু কঠিন রোগে ভুগে কষ্টদায়ক মৃত্যু কি আমরা কেউ চাই? বায়ুদূষণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্বন নিসরণও বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত কার্বন নিসরণ তরান্বিত করে জলবায়ু বিপর্যয়। জলবায়ু বিপর্যয়কে তরান্বিত করে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনছি। এখনই সময় সচেতন হওয়ার, বিশুদ্ধ নিঃশ্বাসের অধিকার নিশ্চিত করার।
উন্নয়ন কর্মী
naima-2810@yahoo.com