নিটল মোটরসের ভ্যাট ফাঁকি ৩৬৫ কোটি টাকা

রহমত রহমান: এক বছরে গাড়ি সরবরাহ করা হয়েছে চার হাজার ৫৫৩ ইউনিট। গাড়ির মধ্যে রয়েছে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ প্রভৃতি। এর মধ্যে চার হাজার ১৯৯ ইউনিটে ভ্যাট দেয়া হয়নি। যানবাহন পরিচালনায় আয় হয়েছে প্রায় এক হাজার ৮৫৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। যার ওপর কোনো ভ্যাট-ই পরিশোধ করা হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যয় ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয়নি উৎসে ভ্যাট। মাত্র এক বছরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ৩৬৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা (সুদ ছাড়া)। নিটল মোটরস লিমিটেডের বিরুদ্ধে এই ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন করেছে যশোর ভ্যাট কমিশনারেট। নিটল মোটরস দেশের স্বনামধন্য নিটল নিলয় গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। তবে ফাঁকি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর পুনঃতদন্তের অনুরোধ জানায় নিটল মোটরস। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি গঠন করে পুনঃতদন্ত করা হয়। এতে ভ্যাট ফাঁকি কমেছে মাত্র এক কোটি দুই লাখ ৫৭ হাজার ১১১ টাকা। ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে। সম্প্রতি যশোর ভ্যাট কমিশনারেট এই দাবিনামা জারি করে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো আইনে নেই, ইচ্ছা করেই ভ্যাট কমিশনারেট দাবিনামা করেছে। কোনো ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়নি।

এনবিআর সূত্রমতে, নিটল মোটরস নিটল নিলয় গ্রুপের একটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। যশোরের কাগজপুকুর এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ভারতের টাটা মোটরস থেকে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, পিকআপ প্রভৃতি যানবাহন সম্পূর্ণ প্রস্তুত (সিবিইউ) অবস্থায় আমদানি করে সরবরাহ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির ২০১৮-১৯ অর্থবছরের নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয় যশোর ভ্যাট কমিশনারেট। ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর এই নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। নিরীক্ষা করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তা সরবরাহ করা হয়। কাগজপত্র পর্যালোচনা শেষে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দেয়া হয়, যাতে সুদ ছাড়া ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। নিরীক্ষায় চার ধরনের অনিয়ম ও ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ক্রয় ও বিক্রয়ের রেজিস্টার যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করা, স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত উপকরণ ক্রয় রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ ছাড়া সরবরাহ করা, উৎসে মূসক যথাযথভাবে কর্তন না করা, পণ্য ও সেবা সরবরাহের বিপরীতে যথাযথ মূসক পরিশোধ না করা।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০২৩ সালের ১৪ জুন যশোর ভ্যাট কমিশনারেট প্রাথমিক দাবিনামাসংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে। প্রতিষ্ঠানকে লিখিত জবাব দিতে ২১ দিনের সময় দেয়া হয়। ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠানকে লিখিত জবাব ও শুনানিতে অংশ নিতে আবারও চিঠি দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা শুনানিতে অংশ নেয়। একই সঙ্গে দাবিনামার বিষয়টি পুনঃতদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যশোর ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে ১২ অক্টোবর একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সব যাচাই ও প্রতিষ্ঠানের জবাবের বিষয় পর্যালোচনা করে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করে। কমিশনারেট নিরীক্ষা করে প্রথমে ৩৬৬ কোটি ৩৯ লাখ ৮৪ হাজার ১১২ টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। পুনঃতদন্ত প্রতিবেদনে ফাঁকি এক কোটি দুই লাখ ৫৭ হাজার ১১১ টাকা কমে দাঁড়ায় ৩৬৫ কোটি ৩৭ লাখ ২৭ হাজার এক টাকা। পুনঃতদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার পর তা পর্যালোচনা করে চলতি ৫ মার্চ চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে।

বিক্রি করা ৪৫৫৩ ইউনিট গাড়ির মধ্যে ৪১৯৯ ইউনিটে ভ্যাট দেয়া হয়নি

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, যশোরের অভয়নগর চেঙ্গুটিয়া প্রেমবাগ এলাকায় অবস্থিত ভারতের টাটা মোটরসের নীতা কোম্পানি এবং নিটল মোটরসের অপর একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার বাংলাদেশি কোম্পানি নিটল মোটরস। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের টাটা মোটরস থেকে বাস, মাইক্রো, পিক-আপ প্রভৃতি সিকেডি অবস্থায় আমদানি করে তা সিবিইউ-তে রূপান্তর করে। পরে উৎপাদিত এই গাড়ি নিটল মোটরসের কাছে বিক্রয় চালানের (মূসক-১১) মাধ্যমে সরবরাহ করে। ওই পণ্যের মূল্য ঘোষণা দিয়ে স্থানীয় বিক্রয়কেন্দ্র এবং দেশব্যাপী স্থাপিত শো-রুমের মাধ্যমে মূসক পরিশোধ করে চালানপত্রের মাধ্যমে সরবরাহ করে। যাচাইয়ে দেখা গেছে, নীতা কোম্পানি তাদের উৎপাদিত সমুদয় পণ্যই নিটল  মোটরসের কাছে বিক্রয় করেছে। তবে নীতা কোম্পানির একই মেয়াদের বিক্রয় তথ্যের সঙ্গে নিটল মোটরসের ক্রয় হিসাবের মিল পাওয়া যায়নি। এ কারণে নীতা কোম্পানির ইস্যু করা বিক্রয় চালান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নীতা কোম্পানি তাদের বিক্রয় করা পণ্যের কিছু অংশ নিটল মোটরসের কাছে সরাসরি মূসক-১১ চালানের মাধ্যমে বিক্রয় করেছে।

বাকি পণ্যের বিক্রয় প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের নামে। এসব বিক্রয় চালানে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে পণ্যের বিক্রয় প্রদর্শন করা হলেও চালানে নিটল মোটরসের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। নিটল মোটরস যেসব পণ্য নিজ নামে নীতা কোম্পানি থেকে কিনেছে, তার মূল্য ঘোষণা দিয়েছে এবং ঘোষিত মূল্যে ভোক্তার কাছে মূসক-১১-এর মাধ্যমে বিক্রয় করেছে। কিন্তু যেগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের নামে চালান ইস্যু করা হয়েছে, সেগুলো নিটল মোটরস ক্রয় বা বিক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি হয়নি। এসব গাড়ির ক্ষেত্রে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিটল মোটরস নীতা কোম্পানি থেকে চার হাজার ৫৫৩ ইউনিট গাড়ি আমদানি করেছে। এর মধ্যে ৩৫৪ ইউনিট গাড়ি ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি করে ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু চার হাজার ১৯৯ ইউনিট গাড়ি ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্টারে এন্ট্রি করা হয়নি, ভ্যাটও পরিশোধ করা হয়নি। এসব গাড়ির মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ৫৫৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার ৭৬৭ টাকা, যাতে প্রযোজ্য মূসক ৮৩ কোটি ১৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৫ টাকা, যা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেনি।

প্রতিষ্ঠানের দাবি, চার হাজার ১৯৯ ইউনিট গাড়ি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন সেবামূলক ব্যবসায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে স্থায়ী সম্পদে রূপান্তর করা হয়েছে। নীতা কোম্পানি থেকে ক্রয় করার পর তা বিআরটিএ থেকে নিটল মোটরসের নামে নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। বাইরের ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়নি। ফলে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে না। তবে তদন্ত কমিটির মত দিয়েছে, ভ্যাট ফাঁকি দিতেই নিটল মোটরস এসব গাড়ি ব্যাংকের নামে ক্রয় করেছে। পরে তা ভোক্তার কাছে কিস্তির মাধ্যমে বিক্রয় করেছে। ফলে এর ওপর ভ্যাট দিতে হবে। তবে প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব গাড়ির নিজস্ব পরিবহন পরিচালনা ও মালিকানার তথ্য চাওয়া হলেও তা সরবরাহ করা হয়নি।

যানবাহন পরিচালনায় ১৮৫৩ কোটি টাকা আয়ের ওপর ভ্যাট দেয়নি ২৭৮ কোটি টাকা

 নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের ‘ইনকাম ফ্রম অপারেটিং ভিহিক্যাল’ বা যানবাহন পরিচালনায় আয় হয়েছে এক হাজার ৮৫৩ কোটি ৫৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৯ টাকা। ১৫ শতাংশ হারে এর ওপর প্রযোজ্য মূসক ২৭৮ কোটি ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৬২ টাকা। প্রতিষ্ঠানের এই আয়ের বিপরীতে খতিয়ান বই, পণ্য বা সেবা ক্রেতার তালিকা, ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি ও নমুনা বিলের কপি দাখিল করতে প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কিছুই দাখিল করেনি। এছাড়া আয়ের বিপরীতে কোনো মূসক-১১ চালান ও বিক্রয় হিসাব রেজিস্টারে উপস্থাপন করেনি। মূসক আইন অনুযায়ী এই খাতের আয় পণ্য পরিবহন, পরিবহন ঠিকাদার ও যানবাহন ভাড়া প্রদানকারী এই তিনটি খায়ের আয় হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠানের এই বিষয়ে বক্তব্য হলো, পরিবহন সেবা অব্যাহতিপ্রাপ্ত। এই সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠান পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করেছে। তবে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এ খাতে প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট দিতে হবে।

প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর ভ্যাট দেয়া হয়নি কোটি ৬২ লাখ টাকা

 নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিটল মোটরস লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় মূসক আইন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর উৎসে মূসক কর্তন করে জমা দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২৭টি খাতে ২৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার ৭১০ টাকা ব্যয় করেছে। যার ওপর ৫-১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট ৩১ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৬৮৯ টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ২৭ কোটি ৪৯ লাখ ৩ হাজার ২৫১ টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি ৩ কোটি ৬২ লাখ ৫৬ হাজার ৪৩৪ টাকা পরিশোধ করেনি।

স্থান স্থাপনা ভাড়ায় ভ্যাট ফাঁকি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা

 নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে স্থান ও স্থাপনা ভাড়া পরিশোধ দেখিয়েছে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৬ হাজার ১৭৪ টাকা। যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য মূসক দুই কোটি ৫৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫০১ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি দুই কোটি ছয় লাখ তিন হাজার ৬১ টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি ৫২ লাখ ৮৬ হাজার ৪৪০ টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানের দাবি, নিরীক্ষায় স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার ওপর মূসক হিসাব করার সময় এনবিআরের ২০১৮ সালের আদেশ অনুসরণ করা হয়নি। তবে কমিটি বলছে, প্রতিষ্ঠানের কাছে কাগজপত্র চাওয়া হলেও তা দেয়া হয়নি।

অন্যদিকে, নিটল-নিলয়ের অনুরোধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি যাচাই শেষে মাত্র এক কোটি টাকার কিছু বেশি ভ্যাট ফাঁকি কমেছে। ভ্যাট ফাঁকির চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মাতলুব আহমাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ইচ্ছে করেই দাবিনামা করেছে। আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি। আমাদের কাছে সব ইয়ারের সার্টিফিকেট রয়েছে। পাঁচ বছর পর এসে বলছে, এই টাকা দিতে হবে। কোনো ল নেই। তারা একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। বলছে বিবিধ। আমরা আলোচনা করছি। ইনশাল্লাহ কাভার হয়ে যাবে।

 

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০