কাজী ফারহানা ইসলাম: দেশে হুট করে দফায় দফায় বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। যেখানে গত সপ্তাহে খুচরা বাজারে কাঁচামরিচ ছিল কেজি প্রতি ৪০ টাকা, সেখানে এক সপ্তাহে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০-৯০ টাকা কেজিপ্রতি, শুধু যে কাঁচামরিচের দাম বেড়েছে তাই নয়; সেই সঙ্গে বেড়ে পেঁয়াজের দাম, মাছ-মাংসের দাম, ডাল, তেল, চিনি, ডিম ও এলপিজি গ্যাসের দাম। এর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। উদাসীন নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার ব্যবস্থা ও অব্যবস্থাপনার ফলে দিন দিন মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে থাকলেও, আয় বাড়ছে না সাধারণ মানুষের। যার ফলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে।
সিলেটে সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ২৫ টাকা। বেড়েছে শাকসবজির দাম ও সয়াবিন তেলের দাম। কয়েকটি বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় গত সপ্তাহে যেখানে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৪০ টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা। ভারতীয় পেঁয়াজের দাম হয়েছে ৪৫ থেকে ৭০ টাকা।
অন্যদিকে বরিশালের বাজারগুলোর চিত্র একই। ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৩০ টাকা। সেই সঙ্গে বেড়েছে আদা ও রসুনের দামও। মাছের বাজারের অবস্থা করুণ। মসুর ডাল ৯০ টাকা, প্যাকেট আটা ৩৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলপ্রতি লিটার ১৩২ টাকা ও বোতলজাত তেল ১৪৫-১৪৮ টাকা লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারের অবস্থা একই। তাছাড়া গরুর মাংস ৫৮০-৬০০ এবং খাসির মাংস ৭৫০-৮০০ টাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে, যা মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে।
প্রাণঘাতী কভিডের প্রভাব পড়েছে বাজারে। গত বছর থেকে এই বছরের দফায় দফায় বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় রয়েছে আগের অবস্থায়। এ অবস্থায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষ। রোজকার চাহিদা পূরণ করতে তাদের গুনতে হচ্ছে পণ্যের স্বাভাবিক দামের থেকে দুই থেকে তিনগুণ বেশি অর্থ। দেশের ও সাধারণ মানুষের বর্তমান অবস্থাকে পুঁজি করে একদল অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি করে চলছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করেও এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে পারছেন না। যার ফলে দুই থেকে তিনগুণ দাম বেশি দিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পণ্য কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বেশ কিছু কারণ পরিলক্ষিত হয়; যেমন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। চাহিদা বৃদ্ধি পেলে এবং পণ্যের জোগান সীমাবদ্ধ হওয়ার ফলে বাজারে ক্রেতার বৃদ্ধি ঘটে। যার কারণে শুরু হয় পণ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা; ফলে মূল্যবৃদ্ধি পায়।
দেশে দিন দিন যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বাড়তি জনসংখ্যার ফলে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও, উৎপাদন ঘাটতির কারণে জোগান অপ্রতুল। যাতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বৃদ্ধি হচ্ছে না চাষাবাদের জমি ও কৃষি শিল্পের কাঁচামাল। যার ফলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধিতে মজুতিদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানি অসাধু ব্যবসায়ীদের ভূমিকা মোক্ষম।
তাছাড়া আমাদের দেশ কৃষিনির্ভরশীল। অবাধে জমি ভরাট ও কৃষকদের ন্যায্য মূল্য না দেয়ার ফলে অনেকেই কৃষিকাজ বিমুখ হয়ে পড়েছেন। যার ফলে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ে ব্যাঘাত ঘটছে।
এই অসাধু ব্যবসায়ীর দল সুযোগ বুঝে হঠাৎ পণ্য গুদামে মজুত করার মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। পণ্যের জন্য চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে এবং অল্প অল্প করে মজুত পণ্য বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়।
এই সময়ে চোরাকারবারিরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় দেশি পণ্য বিদেশে পাচার করে দিলে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি হয়; যার ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
কালোটাকার প্রভাবে সমাজের একশ্রেণির লোকের পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের তুলনায় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। জাতীয় অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও নীতি শিথিল হলে এবং আমলাতন্ত্র দুর্নীতিতে লিপ্ত হলে কালোটাকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। এর পরিণতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি।
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতার কারণে পরিবহন ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, রাস্তাঘাট অবরোধ, যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। তাছাড়া পণ্য বণ্টন ব্যবস্থার ত্রুটির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা, পণ্যের সুষ্ঠু বণ্টন জনগণকে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিয়ে পারত।
প্রত্যক্ষ কর বা ভ্যাটের জন্যও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বাজেটে কোনো পণ্যের কর বৃদ্ধি করার প্রস্তাবনা উঠলে তার মূল্য রাতারাতি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
তাছাড়া দুর্নীতি, অবৈধ চাঁদাবাজির প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যের ওপরে।
পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি বিপাকে ফেলেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ লোকমধ্যম থেকে নি¤œ আয়ের। পণ্যের দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে তাদের ওপর। অধিক দামে পণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা দেশের অধিক মানুষেরই নেই। যার ফলে বাধ্য হয়ে কমাতে হচ্ছে, তাদের দৈনন্দিন বাজার খরচ। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে গেলে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ফলে কমে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মান। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের জন্য বাড়তি অর্থের জোগান দিতে গিয়ে দেখা যায় অনেকেই অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়েন; যার ফলে সামাজিক অবক্ষয়ের দেখা দেয়।
এখনই সময় পণ্যদ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণের। সঠিক বাজার ব্যবস্থা ও নীতিমালা নির্ধারণে মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। যাতে তারা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। এর জন্য দরকার সরকারের নীতিমালা। পণ্যের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে হবে। কৃষি ও শিল্প জাত খাতের কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া ভূমি সংস্কার নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষকদের চাষাবাদে আগ্রহী করতে হবে। কৃষকদের কৃষি কাজের ন্যায্য মূল্য প্রদান করতে হবে। অপরিকল্পিত জমি ভরাট বন্ধ করে খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
সরকারকে বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করতে হবে এবং পণ্যদের দাম নিয়ন্ত্রণে নীতিমালার ব্যবস্থা করতে হবে। কালোবাজারি ও চোরাচালানি রোধ করতে হবে। এতে চাহিদা ও পণ্যের জোগানের একটা ভারসাম্য সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। তাছাড়া রাজনৈতিক ও যোগাযোগ, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। যারা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যাতে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয় এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে, সেই বিষয়টি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়