নিভৃতে থেকেও দীপ্তিমান হায়দার বসুনিয়া। তার তুলনা হতে পারে জোনাকির সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলায় বসে তিনি উত্তর-আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঋদ্ধ। তার লেখা উপন্যাসের পাঠশেষে এ ধারণা করা যায়। অর্ধশত উপন্যাসের লেখক হায়দার বসুনিয়া। মুন্সিয়ানা আছে নাট্য ও কাব্যেও। ৭৮ বছর বয়সী এ লেখকের দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। পড়ার সুযোগ হয়েছে সে বই দুটি।
হায়দার বসুনিয়ার উপন্যাস দুটির একটি ‘পরমতম বর্গাদাতা’। অন্যটি ‘বেতসকুঞ্জের বিড়াল তপস্বী’। দুটি উপন্যাসেরই প্রেক্ষাপট গ্রাম। বিষয়েও মিল রয়েছেÑগ্রামীণ রাজনীতির নানা জটিল-কুটিল চলন-বলন। তবে প্লটের ভিন্নতার কারণে উপন্যাস দুটির দুই বসুনিয়াকে সহজেই আলাদা করা যায়।
‘পরমতম বর্গাদাতা’ উপন্যাসের মূল চরিত্র হানিফ তরফদার, ধনী গওসল তরফদারের ছেলে। যে কি না বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশাল সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে; একই সঙ্গে যে কি না বোকা, নানা ইস্যুতে বিভ্রান্তÑসেই হানিফের জীবনকাহিনি লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন এ উপন্যাসে। বাস্তবজ্ঞানে দৈন্য থাকলে বিশাল সাম্রাজ্যও লুটপাট হয়ে যায় নিমিষে। একদিকে নেহাল মোল্লা, অন্যদিকে নাজির দেওয়ানিয়া পিতাহারা হানিফের উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তারাই হানিফকে সর্বস্বান্ত করে। দেওয়ানিয়ার দেওয়া তাবিজ-কবজ আর সমাজের নানা অপবাদ কাঁধে নিয়ে হানিফের মাও মারা যান। স্ত্রী-সন্তানের মায়া আর দায়িত্বের বোঝা হানিফকে এক করুণ বাস্তবতার মধ্যে ফেলে দেয়। উপন্যাসটির সবটুকু জুড়ে রয়েছে অর্থবিত্তকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পক্ষ-বিপক্ষের দলাদলি। উপন্যাসটির আরেকটি উপকেন্দ্র হচ্ছে নারী; যে কখনও জায়া, কখনও জননী।
গ্রামীণ সমাজের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জমিন আর জনবলই যে মুখ্য, তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উপন্যাসটিতে। হানিফের বাবার ভাষায়, ‘মগজের শিরাগুলো পোক্ত হয়েছে জমিনগুলো করতে গিয়ে অক্লান্ত ভাবনা-চিন্তার ফলে।’ তার মৃত্যুর পর হানিফ ‘স্বীয় পিতার মগজের শিরাগুলো কলমের খোঁচায় কেটে দেয়’ হাসতে হাসতে! এ নিয়ে নানা দ্বিধা-সংশয়ের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে নিঃসন্তান এক মহাজনের বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার নেই। সে পরিবার পরিকল্পনাকারীদের ভর্ৎসনা করে জানতে চায়, ‘সন্তান উৎপাদন বন্ধ করতে পারেন, কিন্তু যাদের সন্তান নেই তাদের সন্তান জš§ানোর ওষুধ আপনাদের কাছে আছে কি না।’ সমাজ জীবনের এ গভীর বৈষম্য নিষ্ঠুরভাবে তুলে ধরা হয়েছে ‘চরমতম বর্গাদাতা’ উপন্যাসে। এখানেই নিভৃতচারী এ ঔপন্যাসিকের ভাবনার সঙ্গে উত্তর-আধুনিকতার অনিশ্চয়তা আর বৈচিত্র্যের মিল পাওয়া যায়। আবিষ্কার করি, গ্রামের স্কুলশিক্ষকের অভিজ্ঞতা তাকে রসদ জোগালেও ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তাকে পূর্ণতা দিয়েছে।
অপর উপন্যাসেও গ্রামীণ রাজনীতির কথকতা তুলে ধরা হয়েছে। সৎ-বুদ্ধিমান ও জনদরদী আফসার মাস্টারের কাঁধে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের মানুষের অসীম অভাব আর সামান্য সরবরাহের মধ্যে যে টানাপড়েন তা অনুভব করেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সমাজসেবকরা সর্বজনগ্রাহ্য থাকেন না বা থাকতে পারেন না। সেই করুণ সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে উপন্যাসটিতে। ওই চেয়ারম্যানই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছেন ‘বেতসকুঞ্জের বিড়াল তপস্বী’ হিসেবে।
সেখানে দেড় বছর ধরে বেতন না পাওয়া চৌকিদারকে তার কাজে মনোযোগের আদেশ করার পাশাপাশি ইউনিয়নের মুন্সি বলেন, ‘গাঁও-গেরামে চৌকিদারের ইজ্জত কত। থানার দারগা-পুলিশ ইউনিয়নে এলে প্রথমে চৌকিদারের খোঁজ পড়ে। ফি-সপ্তাহে একবার থানায় হাজিরা দিয়ে ইউনিয়নের হালহকিকত সোপর্দ করতে হয়Ñএই ইজ্জত কি যার-তার ভাগ্যে জোটে?’ চৌকিদাররা মুন্সির এমন কথা শুনে মুচকি হাসে। বলে, ‘কথা একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। সরকারি পোশাক পরে, কোমরে বেল্ট খিঁচে মাথায় টুপি চাপিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় নামলে মন-মেজাজ অন্যরকম হয়ে যায়। নিজেকে শেঠজি মনে হয়।’ এভাবে গ্রামীণ রাজনীতির নানা ঘটনার ফাঁকে যেসব অনুঘটনা দেওয়া হয়েছে, তা শহুরে পাঠকের মনে একদিকে যেমন বিনোদনের জš§ দেয়, অন্যদিকে তা সুকৌশলে সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোকে চপেটাঘাতও করে।
মূল আবহ ও বয়ানের পাশাপাশি দুটি উপন্যাসে ভাষার প্রয়োগে কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। উত্তরাঞ্চলের সরল সুরে বাক্য ও শব্দের ব্যবহার করেছেন লেখক। আছুদা (ভরপুর), দামান্দ (জামাই) শব্দগুলোর প্রয়োগ করেছেন তিনি। আবার জিজ্ঞাসা বোঝাতে বারবারই এসেছে ‘পুছ করে’ শব্দ। হিন্দিতে ‘পুছা’ মানে জিজ্ঞাসা। আর সেই শব্দটিই রংপুরের কোথাও কোথাও স্থানীয় বাংলায় ব্যবহƒত হয়। হায়দার বসুনিয়া সার্থকভাবেই এ শব্দের ব্যবহার করে বাংলা শব্দভাণ্ডার ভারী করেছেন। একই সঙ্গে অভিজাত কিছু প্রমিত বাংলাশব্দও ব্যবহার করেছেন লেখক। তিনি ঝাড়–র বদলে ‘সামাজ্জনী’ কিংবা আমন্ত্রিত নয় বোঝাতে ‘রবাহুত’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিলুপ্তপ্রায় কিছু শব্দ পুনরুজ্জীতি করার ‘কোশেশ’ লেখক নিয়মিতই করছেন।
বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে প্রকাশিত বই দুটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। ১১৭ পৃষ্ঠার ‘পরমতম বর্গাদাতা’ উপন্যাসটির দাম ২০০ টাকা। ৮০ পৃষ্ঠার অপর বইটির দাম রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা।
জাকারিয়া পলাশ
Add Comment