হোসাইন মুবারক: গ্রামীণ মানুষের কাছে পরিবেশবান্ধব নিমগাছের পরিচিতি অনেক আগের। সবুজে ঘেরা গ্রামবাংলার আনাচকানাচে নিমগাছের ছড়াছড়ি। বাড়ির আশপাশে নিমগাছ থাকলে যেমন কিছুটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া, শীতল ছায়া বিরাজ করে, তেমনি থাকে বারো মাস স্বাস্থ্যসম্মত নির্মল সুবাতাস। হালকা হাওয়ায় হেলেদুলে প্রকৃতিতে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় নিমগাছ।
এ গাছের পাতা, ছাল ও রস ঔষধি গুণে ভরপুর। আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি ওষুধে এ গাছের কদর বেশি। তাছাড়া চর্মরোগ থেকে মুক্তির জন্য নিমের তেল গায়ে মাখেন অনেক গ্রামীণ মানুষ। নিমের তেলই এখন জাতীয় পর্যায়ে শিল্পরূপ পেতে যাচ্ছে। তা-ও আবার কৃষিক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের অনুষঙ্গ হিসেবে।
পাকা নিমফল এমনিতেই জৈবসার হিসেবে কৃষকরা বাড়ির পাশে গর্ত করে আবর্জনার সঙ্গে পচানোর ব্যবস্থা করেন। সেই পচানো আবর্জনা জৈবসার হিসেবে কৃষিজমিতে ব্যবহার হয়। কিন্তু এখন নিম তার গুণাগুণের বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত হয়ে রাসায়নিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে রাসায়নিক সার হিসেবে আবার কৃষিজমিতে ফিরে আসতে যাচ্ছে। আর এ উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠান বিসিআইসি।
‘বিসিআইসি ইউরিয়া সারের সঙ্গে নিমতেল মিশিয়ে নিম-ইউরিয়া উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। প্রথমে পাইলট প্রজেক্ট আকারে এ সার উৎপাদন করা হবে। এরপরই বাণিজ্যিকভাবে। শাহজালাল ফার্টিলাইজার ও যমুনা ফার্টিলাইজার কারখানা নিমতেল মিশ্রিত ইউরিয়া উৎপাদন করবে।’ এ সংবাদ ছাপা হয়েছে ১৯ মে দৈনিক মানবজমিনে।
ওই সূত্রমতে, এ সার সাধারণ ইউরিয়ার তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ বেশি কার্যকর এবং ফলনও দেবে ৬-১২ শতাংশ বেশি। ভেষজ গুণ থাকায় ফসলের বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধেও এ সার ভালো কাজ করবে। ফলে সার হিসেবে কাজ তো করবেই, সে সঙ্গে ফসলের পোকা দমনে কীটনাশকের যে ব্যবহার, তা-ও অনেকাংশে কমে আসবে। এতে প্রকৃতি রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহারে যে বিরূপতায় ভোগে, তা থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসতে পারবে।
গত বছর প্রতিবেশী দেশ ভারতের গুজরাটে নিম ইউরিয়া সার-কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। ওই কারখানাতেই এখন নিম ইউরিয়া উৎপাদিত হচ্ছে। আশার কথা, বাংলাদেশের নিম ফাউন্ডেশন (বিএনএফ) গুজরাটের ওই কারখানার বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। শুধু তা-ই নয়, গুজরাটের ওই কারখানা ঘুরে এসেছেন দেশের সার উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। এর সম্ভাব্যতা যাচাইসহ অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যেই ছিল এ সফর।
দেশে ২৫ বছর ধরে কাজ করছে নিম ফাউন্ডেশন। প্রাথমিকভাবে নিম ফাউন্ডেশনের সঙ্গে নিমের তেল সরবরাহ নিয়ে কথা হয়েছে বিসিআইসির। নিম ফাউন্ডেশন পাঁচ কোটি নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে। সে হিসেবে প্রতিবছর ফাউন্ডেশন ১০০-২০০ টন নিম তেল উৎপাদন করতে পারে। ফাউন্ডেশন রেললাইনের দুই পাশে নিমের চারা লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র এলাকায় গ্রামে গ্রামে প্রচুর নিমগাছ আছে। নিমগাছ এ এলাকার মাটি ও মানুষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় ঘরে ঘরে নিমগাছ রোপণ করে আসছে, ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও ঔষধি গুণের কারণে। যদিও এখন পর্যন্ত এর বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়নি। অথচ এক কেজি নিমের পাতার মূল্য ৪৫ টাকা। তারপরও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশে নিমভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠেনি।
সূত্রমতে, ইউরিয়ার দানায় নিম তেল মাখানোর কারণে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ছে। আগে যে জমিতে ১০ কেজি ইউরিয়া লাগত, সেই জমিতে এখন নিম ইউরিয়া ছয়-সাত কেজি মেশালেই আগের চেয়ে বেশি ফলন হবে। এক্ষেত্রে ব্যবহারকারী কৃষকের তিন-চার কেজি সারের মূল্য সাশ্রয় হবে।
আরেকটি বিষয়, নিমমিশ্রিত ইউরিয়া তিক্ত হওয়ায় ভিন্ন কোনো রাসায়নিক কারখানার কাজে লাগবে না। ফলে কেউ চোরাইভাবে এর ব্যবহার করতে পারবে না।
অনেক কারখানায় মুড়িকে ধবধবে সাদা বানাতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হয়। এতে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে তেমনি ইউরিয়ার অপব্যবহারও হয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ ইউরিয়া সারের ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই এড়ানো যাবে, নিমমিশ্রিত ইউরিয়ার প্রচলনে।
নিম বীজ থেকে নিষ্কাশিত ‘অ্যাজাডিরাকটিন’ সমৃদ্ধ ইমালশনের প্রলেপ ইউরিয়া দানায় সংযুক্ত করে তৈরি করায় নিম-ইউরিয়া সার মাটিতে প্রয়োগ করলে ‘নাইট্রিফিকেশন’ প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হয়। নাইট্রিফিকেশন সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো এতে শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ফলে ইউরিয়ার দানা ধীরে ধীরে নাইট্রোজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে।
এসব কারণে নিম ইউরিয়া কৃষকের মধ্যে যেমন গ্রহণীয় হবে তেমনি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে। কৃষকের বাড়ির পাশের প্রাকৃতিক জৈবসার আবার প্রকৃতিবান্ধব রাসায়নিক সারে রূপ নিয়ে কৃষকের হাতেই ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে রাসায়নিক যৌগের জটিলতা থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে আমাদের প্রকৃতি।
গণমাধ্যমকর্মী
mubarokhosen83Ñgmail.com