Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 8:35 pm

নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্যোগে বড় পতন রক্ষা

মো. আসাদুজ্জামান নূর: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বড় পতন হয়েছিল বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। বিদায়ী সপ্তাহে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্যাপক উত্থান-পতন দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। শুরুতে যুদ্ধের প্রভাবে ব্যাপক পতন হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উদ্যোগে গত তিন কর্মদিবসে উত্থান হয়েছে। ফলে সপ্তাহ শেষে ইতিবাচক না হলেও বড় পতন থেকে রক্ষা পেয়েছে পুঁজিবাজার।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) থেকেই বড় পতন শুরু হয় পুঁজিবাজারে। টানা আট কর্মদিবস পতনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমে ৩৮৩ পয়েন্ট। বাজারে ধসের পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলের ১০০ কোটি টাকা দ্রুত বিনিয়োগের আদেশ এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির পক্ষ থেকে। সেইসঙ্গে এক দিনে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে দুই শতাংশ। এ দুটি সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বাজারে তারল্য বাড়াতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসে বিএসইসি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগ বাড়াবে। যেসব ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের কম বিনিয়োগ আছে, তারা আরও দুই শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে।

এছাড়া ২০২১ সালে বাজারে তারল্য বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তহবিল করার যে সুযোগ দেয়া হয়, সেই তহবিলে যারা টাকা দেয়নি, সেই ব্যাংকগুলো টাকা দেবে; আবার যারা টাকা জমা দিলেও বিনিয়োগে যায়নি, তারা বিনিয়োগে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।

বিএসইসির এমন উদ্যোগের কারণে টানা তিন দিন সূচক বৃদ্ধি পায়। শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সূচকে যোগ হয় ২১১ পয়েন্ট। ফলে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ২৮ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট বা দুই দশমিক ৪২ শতাংশ কমে সপ্তাহ শেষ করে। সূচকটি বর্তমানে ছয় হাজার ৬৬৮ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

আর বাজার মূলধনের শীর্ষ ৩০ কোম্পানির মূল্যসূচক ডিএস৩০ আগের সপ্তাহের চেয়ে ৩৭ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট বা এক দশমিক ৫৪ শতাংশ কমে দুই হাজার ৪২৫ পয়েন্টে নেমেছে। এছাড়া ডিএসইএস বা শরিয়াহ্ সূচক ছয় দশমিক ৫৯ পয়েন্ট বা শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ কমেছে।

অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এভাবে ‘কিছু একটা করে’ পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো যাবে না। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, কারসাজির বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা, যেনতেন কোম্পানির আইপিও না দেয়া এবং ভালো কোম্পানি নিয়ে আসার পরামর্শ দেন।

গত সপ্তাহে ডিএসইতে ৩৯১টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ২০৭টির ও কমেছে ১৫৬টির। আর ২৩টির দাম ছিল অপরিবর্তিত। বেশি সিকিউরিটিজের দর পতনে সূচক নেতিবাচক থাকায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল বেক্সিমকো ফার্মার। কোম্পানিটির এক দশমিক সাত শতাংশ দর পতনে সূচক পড়েছে ১১ দশমিক এক পয়েন্ট। এছাড়া সূচক টেনে নামানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে ব্র্যাক ব্যাংক, রেনাটা, স্কয়ার ফার্মা, অলিম্পিক, গ্রামীণফোন ও আইডিএলসি। সব মিলিয়ে কোম্পানিগুলো সূচক ফেলেছে ৪৭ দশমিক ৯ পয়েন্ট।

বিপরীতে সূচক টেনে তোলার চেষ্টায় ছিল বিকন ফার্মা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, বিডিকম, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ব্যাংক, বিএসআরএম, ওয়ান ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড। কোম্পানিগুলো সূচকে ১৭ দশমিক এক পয়েন্ট যোগ করেছে।

এদিকে সূচক কমলেও আলোচিত সপ্তাহে এক্সচেঞ্জটিতে টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। এ সময়ে লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ৯৭২ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার। আগের সপ্তাহে এটি ছিল তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ২২৬ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টাকার বা ছয় দশমিক শূন্য চার শতাংশ লেনদেন বেড়েছে।

এ বিষয়ে বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, মঙ্গলবার শেষবেলায় উত্থানের আগে বা তার আগের দিন যারা শেয়ার কিনেছিলেন, তারা তৃতীয় কর্মদিবসে মুনাফা করতে পেরেছিলেন। তাই শেয়ার ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা ছিল, যার কারণে টাকার অঙ্কে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।

বিদায়ী সপ্তাহে খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে বস্ত্র খাত। মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক তিন শতাংশ ছিল খাতটির দখলে। বিবিধ খাতে ১৩ শতাংশ লেনদেন করে দ্বিতীয় ও ফার্মা খাতে ১২ দশমিক পাঁচ শতাংশ লেনদেন করে তালিকার তৃতীয় স্থানে ছিল। এছাড়া প্রকৌশল আট দশমিক ৯ শতাংশ, ব্যাংক সাত দশমিক সাত শতাংশ ও খাদ্য খাতে সাত শতাংশ লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন সাত শতাংশের নিচে ছিল।

আলোচিত সপ্তাহে বাজার মূলধনেও নেতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে ছিল পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাজার মূলধন কমেছে তিন হাজার ৩২১ কোটি টাকা। আগের তিন সপ্তাহে বাজার মূলধন কমে ২৮ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। এতে চার সপ্তাহের টানা পতনে ডিএসইর বাজার মূলধন কমল ৩১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।

বাজার মূলধন বাড়া বা কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বেড়েছে বা কমেছে। অর্থাৎ বাজার মূলধন বাড়লে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে বাজার মূলধন কমলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ কমে যায়।

এক্সচেঞ্জটিতে সাপ্তাহিক রিটার্নে দর কমেছে ১৩ খাতে, বেড়েছে সাত খাতে। সবচেয়ে বেশি চার দশমিক ছয় শতাংশ দর কমেছে খাদ্য খাতে। জীবন বিমা খাতে দুই দশমিক চার শতাংশ ও সিমেন্ট খাতে এক দশমিক আট শতাংশ দর কমে তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাকি খাতে দেড় শতাংশের কম দর হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে দর বেড়েছে আইটি, বস্ত্র, মিউচুয়াল ফান্ড, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ভ্রমণ, প্রকৌশল ও সাধারণ বিমা খাতে।

এছাড়া ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) কমেছে। আগের সপ্তাহের চেয়ে পিই রেশিও কমেছে দশমিক ১২ পয়েন্ট বা দশমিক ৭৫ শতাংশ। ডিএসইর পিই রেশিও অবস্থান করছে ১৫ দশমিক ৮৪ পয়েন্টে। এর আগের সপ্তাহে এটি ছিল ১৫ দশমিক ৯৬ পয়েন্ট।

বাজার স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজের সাবেক প্রধান নির্বাহী বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের উন্নয়নে আইন প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। তা না হলে যতই আইন করা হোক কোনো কাজে আসবে না।