মো. আসাদুজ্জামান নূর: চার সপ্তাহ ধরে পতনের পর গত সপ্তাহে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখিতার মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। বিদায়ী সপ্তাহে প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন বেড়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপরে, যা আগের চার সপ্তাহে কমেছিল ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূলধনের পাশাপাশি বেড়েছে সবকটি মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ। বিশ্লেষকদের মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) ‘জোড়াতালিতে’ সামান্য উত্থান হয়েছে।
গত সপ্তাহের প্রতি কর্মদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৭১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে এটি ছিল ৭৯৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কর্মদিবসে গড় লেনদেন বেড়েছে ১৭৭ কোটি ২২ লাখ টাকা বা ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ। এদিকে সপ্তাহটিতে মোট লেনদেন হয়েছে তিন হাজার ৮৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয় তিন হাজার ৯৭২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সে হিসাবে মোট লেনদেন কমেছে ৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বা ২ দশমিক ১৫ শতাংশ। মোট লেনদেন কমার কারণ, বৃহস্পতিবার জাতীয় শিশু দিবসের ছুটির কারণে এক কর্মদিবস কম লেনদেন হয়েছে।
খাতভিত্তিক লেনদেনের শীর্ষে রয়েছে বস্ত্র খাত। মোট লেনদেনের ১৬ শতাংশই ছিল এ খাতের দখলে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফার্মা খাতে লেনদেন হয়েছে ১১.৬ শতাংশ। আর তৃতীয় স্থানে থাকা আইটি খাতে লেনদেন হয়েছে ১১.৩ শতাংশ। এ ছাড়া বিবিধ খাতে ১১ শতাংশ, প্রকৌশল ১০.৮ শতাংশ, ব্যাংক ৭.৫ শতাংশ, খাদ্য এবং জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে ৫.১ শতাংশ লেনদেন হয়েছে। বাকি খাতের লেনদেন চার শতাংশের নিচে ছিল।
আগের সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বড় পতন দেখা দেয় পুঁজিবাজারে। যুদ্ধ শুরুর দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) থেকে টানা আট কর্মদিবস পতনে ডিএসইর প্রধান সূচক কমে ৩৮৩ পয়েন্ট। বাজারে ধসের পরিস্থিতিতে ৮ মার্চ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলের ১০০ কোটি টাকা দ্রুত বিনিয়োগের নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সেই সঙ্গে এক দিনে কোনো কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ২ শতাংশ। এরপর বাজারে তারল্য বাড়াতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসে বিএসইসি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকগুলো বাজারে বিনিয়োগ বাড়াবে। যেসব ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের কম বিনিয়োগ আছে, তারা আরও ২ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াবে। এছাড়া ২০২১ সালে বাজারে তারল্য বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ তহবিল করার যে সুযোগ দেয়া হয়, সেই তহবিলে যারা টাকা দেয়নি, সেই ব্যাংকগুলো টাকা দেবে, আবার যারা টাকা জমা দিলেও বিনিয়োগে যায়নি, তারা বিনিয়োগে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিএসইসির এমন উদ্যোগের কারণে ওই সপ্তাহে টানা তিন দিন সূচক বাড়ে ২১১ পয়েন্ট। ফলে বড় পতনের পরিবর্তে সপ্তাহটিতে ২৮ দশমিক ৩৭ পয়েন্ট সূচক হ্রাস পায়।
অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এভাবে ‘কিছু একটা করে’ পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো যাবে না। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, কারসাজির বিরুদ্ধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা, যেনতেন কোম্পানির আইপিও না দেয়া, ভালো কোম্পানি নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
এদিকে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে না হলেও বিএসইসির দ্রুত পদক্ষেপে সাময়িকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার। দরপতনের সর্বোচ্চ সীমা ২ শতাংশ করার কারণেই বিদায়ী সপ্তাহে সূচক ইতিবাচক থেকে লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। যদিও বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট ও প্রফিট টেকিংয়ের কারণে উত্থান-পতন ছিল সপ্তাহজুড়েই। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে ৯৭ পয়েন্ট ছাড়া নামমাত্র দুদিন সূচক বেড়েছে ও এক দিন কমেছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ১.৫৪ পয়েন্ট ও বুধবার শূন্য দশমিক ১১ পয়েন্ট সূচক বেড়েছে। আর সোমবার সূচক কমেছে ১.৭৯ পয়েন্ট।
এতে গেল সপ্তাহে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৪৪ পয়েন্ট। আগের চার সপ্তাহের টানা পতনে সূচকটি কমে ৪১৭ দশমিক ৮০ পয়েন্ট। এর পাশাপাশি ৩৩ দশমিক ৩৯ পয়েন্ট বেড়েছে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএস৩০ সূচক। আর ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ সূচক বেড়েছে ১৮ দশমিক ৯১ পয়েন্ট। সূচক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেÑরেনাটা, বেক্সিমকো, স্কয়ার ফার্মা, পূবালী ব্যাংক, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ, ব্র্যাক ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের দর বৃদ্ধি।
এদিকে গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। কারণ সাপ্তাহিক লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা; যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গেল সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে পাঁচ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা। আগের চার সপ্তাহে বাজার মূলধন কমে ৩১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
বাজার মূলধন বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়ার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মিলিতভাবে ওই পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ বাজার মূলধন বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। একইভাবে বাজার মূলধন হ্রাস পেলে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পরিমাণ কমে যায়।
সপ্তাহটিতে বাজার মূলধন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। এর বিপরীতে দাম কমেছে ১০৩টির। আর ২৪টির দাম অপরিবর্তিত ছিল।
এতে করে সাপ্তাহিক রিটার্নে দর বেড়েছে ১৭ খাতে। অন্যদিকে দর কমেছে মাত্র ৩ খাতে। সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে। এই খাতে ৬.৩ শতাংশ দর বেড়েছে। আর ভ্রমণ-অবকাশ খাতে ৪.৩ শতাংশ দর বেড়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আইটি খাতে ৩.৩ শতাংশ দর বেড়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাকি খাতের দরবৃদ্ধি তিন শতাংশের নিচে ছিল। অন্যদিকে দর কমেছে কাগজ, ট্যানারি ও সাধারণ বিমা খাতে।
এদিকে সমাপ্ত সপ্তাহে ডিএসইর সার্বিক মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) আগের সপ্তাহের চেয়ে দশমিক ১৯ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। ডিএসইর পিই রেশিও অবস্থান করছে ১৬ দশমিক ০৩ পয়েন্টে। আগের সপ্তাহে এটি ছিল ১৫ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট।