নিয়ম ভঙ্গ করে রেলের ১০ ইঞ্জিন গ্রহণের পাঁয়তারা!

ইসমাইল আলী: চুক্তি ভঙ্গ করে রেলের ১০ ইঞ্জিনে নিন্মমানের যন্ত্রাংশ সংযোজন করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও এর সত্যতা পেয়েছে। এ জন্য ইঞ্জিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম ও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেক্টর সিঙ্গাপুরের সিসিআইসির বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কারোরই শাস্তি হয়নি। উল্টো নিয়ম ভেঙে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে যাচ্ছে রেলওয়ে।

সূত্র জানায়, সরকারি কোনো ক্রয়ের ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ হলেও তা গ্রহণের জন্য সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি বা সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট ইউনিট (সিপিটিইউ) মতামত নিতে হয়। কিন্তু রেলের ১০ ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে তা নেয়া হচ্ছে না। বরং দুর্নীতি আড়াল করতে তৃতীয় একজন ব্যক্তির মাধ্যমে ইঞ্জিনগুলো ক্রয় প্রক্রিয়া রিভিউ করা হয়েছে। বর্তমানে ইঞ্জিনগুলোর গ্রহণ প্রস্তাব রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই ইঞ্জিনগুলো চালানো শুরু করা হবে।

তথ্যমতে, ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) কেনায় হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের ১৭ মে চুক্তি করে রেলওয়ে। গত বছর আগস্টে ইঞ্জিনগুলো দেশে আসে। তবে নিম্নমানের ইঞ্জিন সরবরাহের কারণে অর্থ পরিশোধ আটকে দেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক। নি¤œমানের ইঞ্জিন গ্রহণে অস্বীকৃতিও জানান তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রেলপথ সচিবের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ওই কমিটি।

এতে বলা হয়, ইঞ্জিনগুলো তৈরিতে কারিগরি শর্ত অনুসরণ করা হয়নি। ইঞ্জিন, অলটারনেটর, কম্প্রেসার ও ট্রাকশন মোটর এ চারটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টস চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়নি। ফলে টেস্ট রানের সময় ইঞ্জিনের ব্রেক হর্সপাওয়ার ২২০০বিপিএইচ ও ট্রাকশন হর্সপাওয়ার ২০০০টিএইচপি হওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় যথাক্রমে ২১৭০বিপিএইচ ও ১৯৪২টিএইচপি। এজন্য হুন্দাই রোটেম ও সিসিআইসিকে অভিযুক্ত করা হয়। কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে চুক্তি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়। তবে কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

উল্টো নিন্মমানের ইঞ্জিনগুলো চালানোর উপযুক্ত কিনা তা যাচাইয়ের জন্য ২৩ মার্চ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়। সম্প্রতি এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কারিগরি কমিটি। এতে বলা হয়েছে, হুন্দাই রোটেমের সরবরাহকৃত ১০ ইঞ্জিন চালানোয় কোনো সমস্যা নেই। শুধু ইঞ্জিন ঘুরানোর সময় কিছুটা সমস্যা হয়। তবে বর্তমান অবস্থায় ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের সুযোগ নেই। ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার নিয়োগের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে হবে।

কারিগরি কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে আহসান জাকির নামের এক সাবেক আমলাকে। আর ইঞ্জিনগুলো গ্রহণে কোনো সমস্যা নেই বলে মতামত দেন তিনি। সম্প্রতি ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ারের প্রতিবেদনসহ ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

যদিও বিষয়টি আইনের সরাসরি লঙ্ঘন বলে জানান রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ইঞ্জিনগুলো কেনার আগে দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে সিপিটিইউয়ের অনুমোদন নেয়া হয়েছিল। আর ইঞ্জিনগুলো ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। তাই হুন্দাই রোটেম চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় সংশোধিত প্রস্তাবে সিপিটিইউ ও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির মতামত গ্রহণের সুযোগ নেই।

এদিকে ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ইঞ্জিন কেনায় দুর্নীতি আড়াল করতে আহসান জাকির নামের যাকে ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তিনি চাকরি জীবনে প্রথমে রেলওয়ে ক্যাডারে থাকলেও ২০০৪ সালে প্রশাসনে ক্যাডারে চলে যান। পরে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে রেলের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এছাড়া রেলের কেনা বিতর্কিত ডেমু প্রকল্প মূল্যায়নে আইএমইডির হয়ে দায়িত্বও পালন করেছিলেন আহসান জাকির। ডেমু কেনা প্রকল্প নিয়ে ইতিবাচক মতামত দিয়ে ২০১৭ সালেও তিনি সমালোচিত হন।

এসব বিষয়ে জানতে সম্প্রতি ১০ ইঞ্জিন প্রকল্পের পরিচালক হাসান মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ইন্ডিপেনডেন্ট রিভিউয়ার ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে গোপনীয়তার স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। ওই প্রতিবেদনসহ ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ ও চালানো শুরু করা হবে।

সরকারি ক্রয় কমিটিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কোনো প্রয়োজন নেই। মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রস্তাব পাঠিয়ে জটিলতা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।

এ বিষয়ে জানতে রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে তার দেখা করতে চাইলেও তিনি সম্মত হননি।

প্রসঙ্গত, ইঞ্জিনগুলো কেনায় ঋণ দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। গত জুনে এ ঋণের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তবে এ মেয়াদ আর বাড়াতে রাজি নয় এডিবি। যদিও গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে ছয় মাস। এ হিসেবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে রেলওয়ের হাতে। তাই ইঞ্জিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেমকে দ্রুত মূল্য পরিশোধেই আইন ভঙ্গের পাঁয়তারা করা হচ্ছে।

এদিকে এক বছরের বেশি সময় ধরে ইঞ্জিনগুলো পরে থাকলেও সেগুলোয় ব্যবহƒত নিন্মমানের যন্ত্রাংশ বদলে দেয়নি হুন্দাই রোটেম। এছাড়া হুন্দাই রোটেম ও সিসিআইসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে হাসান মনসুর বলেন, তদন্ত কমিটি না বুঝেই চারটি কম্পোনেন্টে ত্রুটি ধরেছে। শুধু অলটারনেটর ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই। আর টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর দুই হাজার হর্সপাওয়ারের জন্য উপযুক্ত। টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর দরকার নেই। তাই হুন্দাই বা সিসিআইসির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করে চালানো শুরু করাই মূল লক্ষ্য।

এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সবকিছু সিস্টেম অনুযায়ী হচ্ছে। এর বেশিকিছু বলা সম্ভব নয়।

উল্লেখ্য, গত বছর ৯ ডিসেম্বর ‘রেলওয়ের ১০ ইঞ্জিন কেনায় অনিয়ম: নিন্মমানের ইঞ্জিন সরবরাহ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় শেয়ার বিজে। পরবর্তী সময়ে ইঞ্জিনগুলোর অনিয়ম নিয়ে আরও ১০টি প্রতিবেদন শেয়ার বিজে প্রকাশিত হয়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০