ইসমাইল আলী: পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। সে সময় ঢাকা থেকে মাওয়া-ভাঙ্গা হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। তবে প্রথম দুই দফা জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ সঠিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়নি। এতে আবারও বাড়ছে প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণ ব্যয়। পাশাপাশি আরও কিছু খাতে ব্যয় বাড়ছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ১ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। এতে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার ৪০১ কোটি টাকায়। তবে প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন না করেই বাড়তি এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে করতে পারবে রেলওয়ে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত অনুমতি দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।
যদিও ২০ একরের বেশি জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব অনুমোদনের এখতিয়ার পরিকল্পনা কমিশনের নেই। এক্ষেত্রে একনেকের (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন নিতে হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ বৃদ্ধির প্রস্তাবে ২০১৭ সালে এ যুক্তিতে আপত্তি তুলেছিল পরিকল্পনা কমিশন। সরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রের অনুচ্ছেদ ১৬ (১৪)-এর আলোকে পরে এ বিষয়ে একনেকের অনুমোদন নিতে হয়।
যদিও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে তা অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের অনুমোদিত আরডিপিপির সংস্থানকৃত এক হাজার ৭৮৬ একর জমির অতিরিক্ত ৬৪০ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও এজন্য ডিপিপির সংস্থানকৃত ছয় হাজার ২২৪ কোটি ৯২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ৯৪০ কোটি টাকা, ইউটিলিটি শিফটিংয়ের জন্য ডিপিপির সংস্থানকৃত ১৫০ কোটি টাকার অতিরিক্ত ১৫৭ কোটি টাকা ও মিউনিসিপ্যালিটির বর্জ্য অপসারণের জন্য ৫৫ কোটি টাকা এবং রিসেটেলমেন্ট পরিকল্পনা মূল্যায়ন-সংক্রান্ত পরামর্শক নিয়োগের জন্য দুই কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন/প্রস্তাব সরকারি খাতের উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতির সংক্রান্ত পরিপত্রের অনুচ্ছেদ: ১৬ (১৯)-এর আলোকে অনুমোদনের অনুরোধ করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটির অনুমোদিত আরডিপিপির মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই ব্যয়ের ৫ শতাংশের পরিমাণ দাঁড়ায় এক হাজার ৯৬২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তাবিত অনুমোদিত অঙ্গের পরিমাণ ও ব্যয় বৃদ্ধির ফলে এবং দুটি নতুন অঙ্গ অন্তর্ভুক্তির ফলে ব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা, যা পাঁচ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সম্মতি জ্ঞাপন করা হলো। তবে বাড়তি অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যয় না করা এবং প্রকল্পটি পরবর্তী সময়ে সংশোধনকালে তার প্রতিফলনের শর্ত দেয়া হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন সময়সাপেক্ষ। এছাড়া এখনই ডিপিপি দ্বিতীয় সংশোধন করা হলে প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে নির্মাণ প্যাকেজের আবারও সংশোধনী প্রয়োজন হলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি ২০১৬-এর ১৬.১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে বিশেষ সংশোধনের মাধ্যমে কোনো অঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় না। আর ১৬.১৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে কন্টিনজেন্সি কোনো অঙ্গের মাত্র ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা যায়।
এর আগে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো জমি অধিগ্রহণ বৃদ্ধির কারণও তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ডের কারণে বিভিন্ন রেল সেতুর উচ্চতা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। এতে সেতুর উড়াল অংশের (ভায়াডাক্ট) দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে। ফলে জমি বেশি লাগবে। একইভাবে এলজিইডি কর্তৃক বিভিন্ন রোডের আন্ডারপাসের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতেও আন্ডারপাসের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় জমি বেশি দরকার হবে।
এর বাইরে আরএস মৌজা ম্যাপ থেকে বিএস মৌজা ম্যাপে নদী সিকস্তি জমির ধরন পরিবর্তন হয়েছে। এতে ক্ষতিপূরণ বেশি প্রদান করতে হচ্ছে। আর কেরানীগঞ্জ স্টেশন ভায়াডাক্টের নিচের পরিবর্তে পাশে নির্মাণ করতে হচ্ছে বিধায় জমি বেশি লাগবে। এছাড়া শিবচর স্টেশনের অ্যাপ্রোচ সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ, ভাঙ্গা জংশন স্টেশনে খাল ডাইভারসন বাবদ জমি অধিগ্রহণ ও মৌজা ম্যাপ ডিজিটালাইজেশন না হওয়ায় অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করতে হচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, সময়মতো খালি জমি বুঝিয়ে দিতে বিলম্ব হওয়ায় এরই মধ্যে ৪০১ কোটি তিন লাখ টাকা দণ্ডসুদ ও ৪৭৪ দিন অতিরিক্ত দাবি করেছে ঠিকাদার। জমি অধিগ্রহণ আরও বিলম্বিত হলে দণ্ডসুদ ও মেয়াদ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই দ্রুত জমি অধিগ্রহণ শেষে ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দিতে হবে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে বাড়তি অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব অনুমোদনে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়েছে। জানতে চাইলে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ. চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
উল্লেখ্য, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে দুই বছরের মাথায় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এক হাজার ১৫৪ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদনের ফলে এ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে নির্মাণ শেষকালে প্রকল্প ব্যয় আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।